মিশরের ফারাও সম্রাজ্ঞীদের মধ্যে ক্লিওপেট্রার নাম এবং কাহিনী কমবেশী জানিনা এমন কেউ সম্ভবত আমাদের মধ্যে নেই। মিশরে জন্ম না নিয়েও ক্লিওপেট্রা মিশরের ফারাওয়ের রাণী হয়েছিলেন, হয়েছিলেন কিংবদন্তী। ক্লিওপেট্রা যতো না রূপের জন্য, তারচেয়ে বেশী আলোচিত তার ছলনার জন্যে। কিন্তু কিংবদন্তীর আর একজনের কথা হয়তো আমাদের মনেও নেই যিনি রূপে ছিলেন অদ্বিতীয়া, ক্ষমতায় সর্বোচ্চ। প্রায় তিন হাজার তিনশত বছর আগে ইতিহাস যেমন তাকে নিঃশব্দে চাপা দিয়েছে মিশরের বালুরাশির নীচে, তেমনি তিনি আমাদের মনের আড়ালেও চাপা পড়ে আছেন আজো । ক্লিওপেট্রারও হাজার বছর আগে যিনি ছিলেন “লেডি অব অল ওম্যান”, “লেডি অব গ্রেস”, “লেডি অব অল বিউটি”। নাম তার “নেফারতিতি”।
তিনি ছিলেন সর্বকালের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাণী। তার সৌন্দর্য ছিল অতুলনীয়। সমসাময়িককালে তার সৌন্দর্য ও ব্যক্তিত্ব তাকে সারাবিশ্বে জনপ্রিয় করে তুলেছিল। তিনি আজ অবধি মিশরতো বটেই, সমগ্র পৃথিবীর প্রত্নতত্ত্ববিদদের নিকট এক রহস্যময় চরিত্র। বলা হয়, নেফারতিতির সময়ে মিশর ছিল ধন-সম্পদে সারা পৃথিবীর সেরা। নেফারতিতি ছিলেন ক্ষমতাধর মিশররাজ ফারাও চতুর্থ আমেনহোতেপের স্ত্রী এবং ফারাও তুতেনখামেনের সৎ মা।
নেফারতিতির বংশপরিচয় সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায় না। কেউ কেউ বলেন, তিনি প্রাচীন মিশরের আখমিম শহরের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আই এর সন্তান অথবা ভাইঝি/ভাগ্নি। অপর বিশেষজ্ঞগণ বলেন, নেফারতিতি মিশরীয় ছিলেন না।
তিনি সিরিয়ার অধিবাসী ছিলেন। সে যাই হোক, মাত্র ১৫ বছর বয়সে শাহজাদা চতুর্থ আমেনহোতেপের সঙ্গে তার বিয়ে সম্পন্ন হয়। তখনও চতুর্থ আমেনহোতেপ সিংহাসনে আরোহণ করেন নি। চতুর্থ আমেনহোতেপ এবং নেফারতিতির মধ্যে ভালবাসার অন্যরকম সম্পর্ক ছিল যা পূর্ববর্তী রাজা-রানীর মধ্যে অতটা চোখে পড়ত না। প্রজা-সাধারণ অবাক হয়ে দেখত, প্রায়ই সম্রাট-সম্রজ্ঞী রথে চড়ে শহরে ঘুরতে বেরিয়েছেন। এমনকি তাদের প্রকাশ্যে পরস্পরকে চুমু খেতেও দেখা যেত। পরবর্তী ১২ বছরে নেফারতিতির গর্ভে ছ’জন কন্যাসন্তান জন্মলাভ করেন।
ফারাও তৃতীয় আমেনহোতেপের মৃত্যুর পর চতুর্থ আমেনহোতেপ সিংহাসনে আরোহণ করেই বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তন্মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল মিশরের আদি-ধর্মের সংস্কার। চতুর্থ আমেনহোতেপের এসব সংস্কার কর্মে নেফারতিতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তৎকালীন মিশরবাসী প্রধান দেবতা আমেন রা এর পাশাপাশি অনেক দেব-দেবীর পূজাতে মত্ত ছিল। ফারাও চতুর্থ আমেনহোতেপ এবং রানী নেফারতিতি এক সূর্যের পূজা অর্চনা শুরু করেন। তারা প্রচার করেন, সূর্যই সবচেয়ে শক্তিশালী দেবতা এবং একমাত্র উপাসনার যোগ্য। তাদের এই প্রচারণা জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক আলোড়নের জন্ম দেয়। অধিকন্তু রাজপরিবার সদস্যদের বসবাসের জন্য ফারাও চতুর্থ আমেনহোতেপ আখেতাতুন শহরের গোড়াপত্তন করেন এবং সেখানকার রাজপ্রাসাদ ঘিরে কয়েকটি সূর্যদেবতার মন্দির গড়ে তোলেন।
নেফারতিতি সূর্যদেবতার প্রতি এতটাই নিবেদিত প্রাণ ছিলেন যে, নিজের নাম ‘নেফারতিতি’ পরিবর্তন করে ‘নেফারনেফারুআতেন নেফারতিতি’ নাম গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে ফারাও চতুর্থ আমেনহোতেপও সূর্যদেবতাকে সন্তুষ্ট করতে নিজের নাম পরিবর্তন করে আখেনআতেন রাখেন। বিশ্বাস করা হয় যে, এই নতুন পূজাপদ্ধতির পুরোহিত ছিলেন সম্রাট ও সম্রাজ্ঞী নিজেরাই এবং কেউ যদি সূর্যদেবতার উদ্দেশ্যে পূজা অর্চনা করতে চাইত তবে তাকে সম্রাট এবং সম্রাজ্ঞীর মাধ্যমেই তা করতে হত। এ পদ্ধতি মিশরবাসীর কাছে সম্পূর্ণ নতুন ছিল এবং এর ফলে দিকে দিকে তাদের নাম ছড়িয়ে পড়ে।
শুধু রাজকার্য এবং ধর্মচর্চা নয়, ফারাও আখেনআতেন ও রানী নেফারতিতির আমলে চিত্রকলায় নতুন ধারা শুরু হয়। রানী নেফারতিতি এবং তার কন্যাগণের যেসব ছবি এপর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়েছে তার সাথে আগের যুগের চিত্রকলার ধারার সামঞ্জস্য পাওয়া যায় না। তবে অবাক করা বিষয় হল, ফারাও আখেনআতেনের ১২ বছর শাসনামল শেষ হবার পর নেফারতিতি সম্পর্কে কোন সঠিক তথ্য পাওয়া না। তবে কি ফারাও আখেনআতেনের মৃত্যুর পর নেফারতিতিকে গোপনে হত্যা করা হয়?
কোন কোন বিশেষজ্ঞ বলেন, তার মৃত্যু হয়েছিল। কেউবা বলেন, ফারাও আখেনআতেনের মৃত্যুর পর নেফারতিতি পুরুষবেশ ধারণ করেন এবং পরবর্তী ফারাও তুতেনখামেনের প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া অবধি মিশররাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন। অন্যদল বলেন, আখেনআতেনের মৃত্যুর পর নেফারতিতি ফারাও ঝসবহশযশধৎব উপাধি ধারণ করে মিশরের রাজসিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। নেফারতিতির রাজমুকুট পরিহিত কিছু ছবি সেদিকেই ইঙ্গিত দেয়। আরেকদল বিশেষজ্ঞ এসকল ধারণাকে নাকচ করে দিয়ে বলেন, ফারাও আখেনআতেনের মৃত্যুর পর একসময় পূর্ববর্তী দেবতা আমেন-রার পূজা আবার সমাজে জনপ্রিয় হয়ে উঠে এবং রানী নেফারতিতিকে অজ্ঞাত নির্বাসনে পাঠান হয়।
আসলে রাণী নেফারতিতির ভাগ্যে কি ঘটেছিল? জানতে হলে আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। ২০১৫ সালের আগস্ট মাসে তুতেনখামেনের সমাধির দেয়ালের স্ক্যান করা ছবি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে যেয়ে বিট্রিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ নিকোলাস রিভস দেয়ালের গায়ে গোপন দরজার নকশা দেখতে পান। পরে আরও সূক্ষ্মভাবে স্ক্যান করে দেখা যায় উক্ত দেয়ালের পাশে ফাঁকা জায়গা রয়েছে যা কোন আলাদা কক্ষ হতে পারে। নিকোলাস রিভস মনে করেন, তুতেনখামেনের সমাধিস্থল সর্বপ্রথম রানী নেফারতিতি দখল করেন এবং সমাধির দেয়ালের অপর পাশেই নেফারতিতি সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় ঘুমিয়ে আছেন। নিকোলাস রিভসের ধারণা সত্যি হলে ১৯২২ সালে তুতেনখামেনের সমাধি আবিষ্কারের পর প্রত্নতত্ত্বের ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হবে। এ ব্যাপারে অনুসন্ধানকারী দল ৯০ভাগ নিশ্চিত হলেও মিশরীয় কর্তৃপক্ষ পরবর্তী পদক্ষেপ নেবার আগে ১০০ ভাগ নিশ্চিত হতে চাইছে।
আশা করা হচ্ছে, রানী নেফারতিতির খোঁজ পাওয়া গেলে মিশরের পর্যটন শিল্পের পালে নতুন করে হাওয়া লাগবে। মিশরের হোসনি মোবারকের আমলে মিশর ছিল পর্যটক আকর্ষণকারী অন্যতম আফ্রিকান দেশ। পরবর্তীতে রাজনৈতিক অস্থিরতায় তা অনেকটাই স্তিমিত হয়ে যায়। মৃত্যুর প্রায় ৩৩০০ বছর পরে আবার হয়ত রানী নেফারতিতি মিশরের অর্থনীতিতে বলিষ্ঠ অবদান রাখতে সমর্থ হবেন।
Facebook Comments