যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত স্বঘোষিত প্রেসিডেন্টের সমর্থনে দেশে ত্রাণ প্রবেশ নিয়ে উত্তাল হয়ে উঠেছে ভেনেজুয়েলার সীমান্ত। ত্রাণবাহী ট্রাক ভেনেজুয়েলায় ঢুকতে দেওয়ার দাবিতে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে সরকারবিরোধীরা। তারা সীমান্ত এলাকার রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড বসিয়েছে। মোড়ে মোড়ে টায়ার জ্বালিয়ে নিজেদের অবস্থানের জানান দিচ্ছে। আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে সরকারি বাহিনী। নিরাপত্তা বাহিনীর দিকে পাথর নিক্ষেপ করে তারাও পাল্টা জবাব দেওয়ার চেষ্টা করে। আগের দিন শুক্রবারও ত্রাণ প্রবেশ নিয়ে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। দুই দিনে উভয় পক্ষের সংঘর্ষে অন্তত চারজন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে আরও শতাধিক মানুষ। কলম্বিয়া সরকারের দাবি অনুযায়ী, শুধু ভেনেজুয়েলা-কলম্বিয়া সীমান্তেই ত্রাণ প্রবেশকে কেন্দ্র করে উত্তেজনায় আহত হয়েছে ২৮৫ জন।
প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিকরা জানিয়েছেন, আহতদের মধ্যে অনেকের অবস্থা গুরুতর। অনেকে তাদের চোখ হারিয়েছেন। আন্দোলনকারীদের ওপর সরকারি বাহিনীর আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। সংস্থাটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ ঘটনা মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘন, যা আন্তর্জাতিক আইনে বিচারযোগ্য।
গত দুই দিনে নিহতদের মধ্যে পেমন আদিবাসী গোষ্ঠীর দুই সদস্য রয়েছেন। সরকারি বাহিনী গুলি চালিয়ে তাদের হত্যা করে। এই আদিবাসীরা ত্রাণ সরবরাহ নির্বিঘ্ন করতে সীমান্ত খোলা রাখার পক্ষপাতী। কামারাকাকপে শহরের প্রান্তে অবস্থিত ব্রাজিল সীমান্তে ভেনেজুয়েলার সেনাবাহিনী ও ন্যাশনাল গার্ড ট্যাংক নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল, ত্রাণ সরবরাহ বাধাগ্রস্ত করতে। আদিবাসী গোষ্ঠীর সদস্যরা সেনা বহরটিকে অগ্রসর হতে বাধা দিলে সংঘর্ষের সূচনা হয়। শনিবার অন্য দুইজন নিহত হয়েছেন ব্রাজিল সীমান্তে ছড়িয়ে পড়া সংঘাতের সময়।
ভেনেজুয়েলার সরকারি বাহিনীর গুলিবর্ষণের হুমকির পর ফিরে গেছে পুয়ের্তো রিকো থেকে আসা একটি ত্রাণবাহী জাহাজ। কলম্বিয়া সীমান্তে ত্রাণবাহী ট্রাকে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। টেলিভিশনে সম্প্রচারিত ফুটেজে দেখা যায়, একটি ট্রাকে আগুন লাগার পর আরেকটি ট্রাক থেকে ত্রাণের বাক্স সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট হুয়ান গুইদো’র অভিযোগ, সরকারের লোকজনই ট্রাকে আগুন দেওয়ার চেষ্টা করছে। আর সাহসী স্বেচ্ছাসেবীরা ট্রাকভর্তি ত্রাণসামগ্রী রক্ষার চেষ্টা করছেন। সরাসরি ভেনেজুয়েলায় প্রবেশ করতে না পেরে যুক্তরাষ্ট্রের ত্রাণবহর প্রথমে বিমানে করে কলম্বিয়ায় পাঠানো হয়। পরে তা স্থলপথে ভেনেজুয়েলা সীমান্তে পৌঁছে দেওয়া হয়। কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্টকে সঙ্গে নিয়ে সীমান্তের কলম্বিয়া অংশ পরিদর্শন করেছেন হুয়ান গুইদো। এসব ঘটনায় কলম্বিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে দেশটির কূটনীতিকদের ভেনেজুয়েলা ত্যাগের জন্য ২৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়েছে কারাকাস।
ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো বলেছেন, তার দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মার্কিন হস্তক্ষেপে সহযোগিতার কারণে কলম্বিয়ার বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। শনিবার রাজধানী কারাকাসে আয়োজিত এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দানকালে তিনি এমন মন্তব্য করেন। এদিন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী নীতির মোকাবিলায় দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার সংকল্প পুনর্ব্যক্ত করেন মাদুরো।
তিনি বলেন, ভেনেজুয়েলা দখলের অপচেষ্টার অংশ হিসেবে এই ত্রাণকে ব্যবহার করছে যুক্তরাষ্ট্র। আমেরিকা ও তার সহযোগীরা ত্রাণ পাঠানোর নামে দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতাকে ভূলুণ্ঠিত করতে চায়।
এদিকে আন্তর্জাতিক ত্রাণের চালান ভেনেজুয়েলা সীমান্তে প্রবেশের ঘটনায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন মার্কিন সমর্থিত স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট হুয়ান গুইদো। ব্রাজিল সীমান্তে একটি ত্রাণবাহী ট্রাকের সঙ্গে দেখা গেছে তাকে। সরকারকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে সীমান্ত থেকে দেশে এই ত্রাণ নিয়ে আসার প্রচেষ্টায় যুক্ত সমর্থকদের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন হুয়ান গুইদো। সোশ্যাল মিডিয়ায় দেওয়া পোস্টে তিনি একে ‘অভূতপূর্ব বীরত্ব’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা ছবিতে সরকারের বলপ্রয়োগের নানা দৃশ্য তুলে ধরছেন গুইদো সমর্থকরা।
হুয়ান গুইদো বলেন, ‘সরকার যদি মনে করে বিরোধীরা রাস্তা ছেড়ে দেবে, তাহলে তারা ভুল করবে। স্বাধীনতা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আমরা রাজপথে অবস্থান করবো।’ তবে প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো’র দাবি, ভেনেজুয়েলা ভিক্ষুক নয় যে মার্কিন ত্রাণ গ্রহণ করবে। অথচ খাদ্য-ওষুধের প্রবল সংকটে থাকা ভেনেজুয়েলাবাসী আশ্রয় নিচ্ছে প্রতিবেশী কলম্বিয়া, ব্রাজিলের মতো দেশে। এদিকে দেশজুড়ে সংঘাত-সহিংসতার মধ্যে মাদুরো সরকারের ওপর থেকে ধীরে ধীরে সমর্থন প্রত্যাহার করতে শুরু করেছেন সরকারি বাহিনীর অনেক সদস্য।
শনিবার ন্যাশনাল গার্ডের অন্তত চার সদস্যের পক্ষত্যাগের ঘটনা ঘটেছে। পক্ষত্যাগী সদস্যদের স্বাগত জানিয়ে হুয়ান গুইদো বলেন, ইতিহাসের সঠিক বাঁকে আপনাকের স্বাগত। নিরাপত্তা বাহিনীর অন্য যেসব সদস্য পক্ষত্যাগ করবেন তাদেরও দায়মুক্তির নিশ্চয়তা দেওয়া হবে।
কলম্বিয়ার অভিবাসন দফতর জানিয়েছে, ২৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ভেনেজুয়েলার নিরাপত্তা বাহিনীর অন্তত ৬০ জন সদস্য পক্ষত্যাগ করেছেন। সর্বশেষ শনিবার পক্ষত্যাগী ন্যাশনাল গার্ডের চার সদস্য ভিডিও বার্তায় মাদুরো সরকারের সমালোচনা করে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত স্বঘোষিত প্রেসিডেন্টের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন।
এদিকে শনিবারের সমাবেশে হুয়ান গুইদো’কে যুক্তরাষ্ট্রের পুতুল ও সাম্রাজ্যবাদের কাছে ভিক্ষা চাওয়ার রাজনীতিক হিসেবে আখ্যায়িত করেন মাদুরো। একইসঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ভেনেজুয়েলা থেকে লেজ গুটিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, বিবিসি মিয়ামি হেরাল্ড। ছবি সংগৃহিত।
Facebook Comments