ছোটদের কাছে প্রিয় মানুষে পরিণত হয়ে যান অল্পদিনেই। ছোটদের-বড়দের সকলের জন্য লিখেছিলেন এই ছেলেটি। সিনেমা, নাটক, গান, উপন্যাস, গল্প- সব জায়গাতে ছিল তাঁর পদচারণা। এখন যদি প্রশ্ন করা হয়, কে ছিলেন এই কাজল? আর একটু ধারণা দিয়ে বলি তার মায়ের নাম আয়েশা ফয়েজ, ‘যদি মন কাঁদে তুমি দিয়ে ফিরে এসো’ এই জনপ্রিয় গানটি তাঁর লেখা।
আমি হুমায়ূন আহমেদের কথা বলছি। প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদের ডাক নাম ছিল কাজল। ছোটদের নিয়ে খুব ভাবতেন তিনি।। আর তাই তো খুব সহজেই ছোটদের মনের মাঝে জায়গা করে নিতে পেরেছিলেন।
একদিনে হুমায়ূন আহমেদ তৈরি হননি। অনেক কষ্ট আর পরিশ্রম করে তিনি হুমায়ূন আহমেদ হয়ে উঠেছিলেন। লেখালেখি করে তিনি সবার কাছে এত বেশি জনপ্রিয় হয়েছিলেন যে বাংলা সাহিত্যে তাঁর স্থান আর হয়তো কেউ দখল করতে পারবে না।
ছোটদের প্রিয় এই লেখক ছেলেবেলায় খুব দুরন্ত ছিলেন। একবার হুমায়ূন আহমেদের মেজোচাচা তাঁকে কিশোরীমোহন পাঠশালায় ভর্তি করিয়ে দেন এবং সেখানে তিনি প্রথমদিনেই হাতের কনুই দিয়ে মেরে একটি ছেলের সামনের দাঁত ভেঙে দিয়েছিলেন। কী সাংঘাতিক কথা, তাই না?
অবশ্য এর জন্য হেডমাস্টার সাহেব যতক্ষণ ক্লাস চলেছিল, ততক্ষণ তাকে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন। আর ক্লাসের সবাইকে বলেছিলেন, সাবধান থাকবে, ও কিন্তু পুলিশের (হুমায়ূন আহমেদের বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ পেশায় ছিলেন একজন পুলিশ কর্মকর্তা) ছেলে। আর পুলিশের ছেলেরা গুণ্ডা হয়।
হুমায়ূন আহমেদ তখন ক্লাস সিক্সে পড়েন। পড়া বলতে না পারায় স্যার তাঁর গলায় সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেন। আর তাতে লেখা ছিল– ‘আমি পড়া পারি নাই আমি গাধা’। এভাবে তাঁকে সারা স্কুল ঘুরতে বলা হলে তিনি গলা থেকে সাইনবোর্ড খুলে ফেলেন আর স্যারকে বলেন, “আপনি গাধা!”
তারপর এক দৌড়ে স্কুল থেকে পালিয়ে গেলেন। পরে অবশ্য ঐ স্যারের কাছ থেকে মাফ চেয়ে নিয়েছিলেন।
হুমায়ূন আহমেদ শুধু দুষ্টুমি করতেন, তা শুধু নয়। তিনি কিন্তু অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। সবসময় ভালো রেজাল্ট করতেন। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি রসায়নে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। এরপরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটা ইউনিভার্সিটি থেকে পলিমার রসায়ন বিষয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।
সেখান থেকে ফিরে তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। কিন্তু লেখা যার রক্তে মিশে আছে, তাঁর কি অধ্যাপনা মানায়? তিনি অধ্যাপনা ছেড়ে লেখালেখি শুরু করেন। পাশাপাশি নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মাণেও আত্মনিয়োগ করেন।
নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের অন্যতম সৃষ্টি হিমু এবং মিসির আলী। যুক্তির বাইরে চলা এক খামখেয়ালি যুবক হল হিমু। মিসির আলী একজন মধ্যবয়সী যুক্তিবাদী অধ্যাপক। এ দুটি চরিত্রের মাধ্যমে তিনি লজিক আর অ্যান্টিলজিকের দোলায় দুলিয়েছেন কোটি পাঠককে। হুমায়ূন আহমেদের আরও দুটি জনপ্রিয় চরিত্র হল শুভ্র এবং রূপা।
তিনি ভালোবাসতেন ছোটদের। তাই তিনি ছোটদের জন্য লিখেছেন বেশ কিছু মজার মজার বই। যার জন্য আজ তিনি ছোটদের কাছে খুব পরিচিত একটি নাম। ছোটদের জন্য লেখা তাঁর বইগুলো হল- নীল হাতি, তোমাদের জন্য রূপকথা, টগর এন্ড জেরি, তিনি ও সে, প্রিয় ভয়ংকর, পরীর মেয়ে মেঘবতী, কানি ডাইনি, কাক ও কাঠগোলাপ, জন্মদিনের উপহার, এই ছেলেটা, বোতল ভূত, পুতুল, সূর্যের দিন, ছোটদের সেরা গল্প, ছোটদের যত লেখা, ছোটদের জন্য এক ব্যাগ হুমায়ূন ইত্যাদি।
এবার তুলে ধরব হুমায়ূন আহমেদের বিভিন্ন শাখায় প্রথম কাজগুলো। তাঁর লেখা প্রথম উপন্যাস ছিল শঙ্খনীল কারাগার আর তাঁর প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস- নন্দিত নরকে (১৯৭৩)। প্রথম কল্পবিজ্ঞানের বই- তোমাদের জন্য ভালোবাসা (১৯৭৩)। প্রথম টিভি নাটক- এইসব দিনরাত্রি (১৯৮৪) প্রথম পরিচালিত চলচ্চিত্র- আগুনের পরশমণি (১৯৯৪)।
হুমায়ূন আহমেদ সবসময় প্রকৃতি ও ছোটদের ভালোবাসতেন। মিশে থাকতে চেয়েছিলেন ছোটদের মাঝে, প্রকৃতির মাঝে। আর তাই তিনি গাজীপুরে গড়েছিলেন নুহাশ পল্লী, যেখানে তিনি চির নিন্দ্রায় শায়িত আছেন।
Facebook Comments