২০১৫ সাল, ডেনিম অ্যান্ড জিন্সের আয়োজনে নতুন ফ্যাশন ডিজাইনারদের নকশা করা পোশাক নিয়ে একটি প্রতিযোগিতা ও প্রদর্শনীর আয়োজন করা হবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়। এ আয়োজনে যে কেউ নিজের নকশা করা পোশাক উপস্থাপন করে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। এমন ঘোষণা শুনে উঠতি ফ্যাশন ডিজাইনারদের অনেকেই একটু নড়েচড়ে বসেছিলেন। সেই তালিকায় ছিলেন বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাশন ডিজাইন অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের দ্বিতীয় সেমিস্টারের শিক্ষার্থী রোকাইয়া আহেমদ পূর্ণাও। যদিও পূর্ণা ভেবেছিলেন এই প্রতিযোগিতায় শুধু উপরের সেমিস্টারের সিনিয়র ভাইয়া-আপুরাই অংশগ্রহণ করতে পারবেন। সেই ভুল অবশ্য ভেঙে গিয়েছিল ক্ষণিকেই। যে শিক্ষকের মাধ্যমে তারা এমন প্রতিযোগিতার কথা জানতে পারেন, তিনিই নাকি বলেছিলেন নিচের সেমিস্টারের শিক্ষার্থীরাও চাইলে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পারবে। তাহলে আর বাধা কই, ঠিক এমন কথাই তখন বেজে উঠেছে পূর্ণার মনে।
বলে রাখা ভালো, অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে সবচেয়ে জুনিয়র ছিলেন তিনি। যা-ই হোক, প্রতিযোগিতায় যেহেতু অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছেন, তাই আর এদিক সেদিক না তাকিয়ে জামা নকশা করা শুরু করলেন। সেসঙ্গে নকশা করেন পুনরায় ব্যবহার করা উপাদানে তৈরি অভিনব একটি হ্যাট। প্রতিযোগিতার নিয়ম অনুযায়ী এসব জমা দিলেন ডেনিম অ্যান্ড জিন্সের ইন্টারন্যাশনাল ফেস্টিভ্যালে। আয়োজক ও বিচারকদের বেশ পছন্দ হয়েছিল পূর্ণার নকশা করা পোশাক ও হ্যাট। তবে জামা থেকে কিছুটা যেন এগিয়ে ছিল আকর্ষণীয় হ্যাটটি। সেটি সবার কাছেই বেশ সমাদৃত হয়েছিল। যার কারণে সেই ফেস্টিভ্যালের একটি কিউতে রাখা হয়েছিল পূর্ণার নকশা করা প্রায় ৩০টি হ্যাট। সেরা দশে তার নকশার পোশাকটি স্থান করে নিতে না পারলেও ডেনিম অ্যান্ড জিন্সের ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন শোতে প্রদর্শিত হয়েছিল সেটি। অন্যদিকে হ্যাটটি বাগিয়ে নিয়েছিল বেস্ট অ্যাকসেসরিজ অ্যাওয়ার্ড। একদম নতুন নকশাকার হিসেবে এটা যে বেশ বড় পুরস্কার, সেটা বলাই বাহুল্য।
তরুণ নকশাকার হিসেবে এভাবেই পথচলা শুরু রোকাইয়া আহেমদ পূর্ণার। একদম নতুন নকশাকার হিসেবে যেহেতু পুরস্কার অর্জন করা সম্ভব হয়েছে, সেহেতু চেষ্টা করলে আরো বড় কিছু অর্জন করা সম্ভব, ঠিক এই কথাটি মনে গেঁথে ফেলেন তিনি। বলা চলে প্রথম পুরস্কার প্রাপ্তি অনুপ্রেরণা হয়ে কাজ করছে।
সে বছরই পূর্ণা স্পেনের বিলবাও ইন্টারন্যাশনাল আর্ট অ্যান্ড ফ্যাশন প্রতিযোগিতায় নিজের নকশা করা পোশাক পাঠান। বেশ কয়েক ধাপে চলতে থাকে প্রতিযোগিতা। প্রথম ধাপের পর আর্থিক সমস্যার কারণে পরবর্তী ধাপগুলোয় অংশগ্রহণ করা সম্ভব হয়নি তার। পূর্ণা বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মানের একটি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পেরেছি এটাতেই মোটামুটি সন্তুষ্ট। পুরস্কার প্রাপ্তি কিংবা চূড়ান্ত পর্যায় পর্যন্ত যাওয়া উদ্দেশ্য ছিল না বরং শেখাটাই ছিল মুখ্য।’
এর পরের বছর অর্থাত্ ২০১৬ সালে কিন্তু ডেনিম অ্যান্ড জিন্স ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন ফেস্টিভ্যালে দলীয়ভাবে নিজেদের নকশা করা পোশাক দিয়ে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন তারা। এর পাশাপাশি পূর্ণা কস্টিউম ডিজাইনার হিসেবেও কাজ করতে থাকেন। এছাড়া বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণসহ বিভিন্ন প্রজেক্টে কাজ করে যাচ্ছিলেন এ তরুণী। বর্তমানে ঠিক তেমনই একটি প্রজেক্ট ওয়ার্ক করছেন আন্তর্জাতিক সংস্থা সোসাইটি অব ডাইয়ারস অ্যান্ড কালারিস্টস, সংক্ষেপে এসডিসির সঙ্গে। যেখানে তিনি কাজ করেছেন জিরো ওয়েস্ট ও টেকসই নকশাকে মূল প্রতিপাদ্য করে। পুরনো কাপড়, প্রাকৃতিক রঙ এবং ভাতের মার ব্যবহার করে তৈরি করেছিলেন টি-শার্ট ও টপস। পূর্ণা বলেন, ‘যেহেতু পোশাক নকশাকার হিসেবে শুধু পোশাক নকশা করলেই হয় না, ভাবতে হয় পরিবেশের কথাও। অন্যদিকে এসডিসিতে প্রজেক্ট জমা দেয়ার শর্ত হচ্ছে পোশাকের নকশার সঙ্গে এটি কীভাবে তৈরি হচ্ছে, ওয়েস্টেজ কমানোর জন্য কী করতে হচ্ছে, এসবের একটা সমাধানও দিয়ে দিতে হয়। আমি সমাধান দিয়েছি এভাবে, আমার নকশার পোশাকে ব্যবহার করেছি পুরনো কাপড়। সেসঙ্গে সাশ্রয় হওয়া কাপড়ের টুকরাগুলো ব্যবহার করা হয়েছে স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরিতে। পোশাক তৈরির পেছনে যেসব নারী কাজ করেছেন, তাদেরকে সেসব সরবরাহ করা হয়েছে। অর্থাত্ সম্পূর্ণ টেকসই ও পরিবেশবান্ধব উপায়ে জিরো ওয়েস্টেজে পোশাক প্রস্তুত করা সম্ভব।’
এখানেই শেষ না, আসছে মাসের ১৯ তারিখ আত্মপ্রত্যয়ী এ তরুণী পাড়ি জমাচ্ছেন চীনে। সেখানে উহান ফ্যাশন উইক ২০১৭তে প্রদর্শিত হতে যাচ্ছে তার নকশা করা পোশাক। বাংলাদেশ থেকে তরুণ ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন তিনি।
অন্যদিকে পূর্ণার হাত ধরে শুরু হয়েছে স্বেচ্ছাসেবক সংগঠন ইয়ুথ সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন। যেখানে পূর্ণার মতোই কাজ করছেন আরো অনেক তরুণ-তরুণী। যারা সুবিধাবঞ্চিত নারী, শিশু, থার্ড জেন্ডারদের নিয়ে কাজ করছেন। তাদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছেন।
এত কাজের কাজী পূর্ণা কিন্তু ঘুরে বেড়াতে ভীষণ ভালোবাসেন। যদিও পড়াশোনা আর কাজ দুটোর সমন্বয় করতে গিয়ে সেভাবে ঘুরে বেড়ানো হয়ে ওঠে না। তবে ইচ্ছা আছে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান ঘুরে বেড়াবেন কোনো একসময়। স্বপ্ন দেখেন কোনো একদিন হবেন অনেক বড় ফ্যাশন ডিজাইনার। যখন তার নামেই মানুষ তাকে চিনবে। ঠিক যেমনটা বাংলাদেশের ফ্যাশন আইকন বিবি রাসেল।
Facebook Comments