আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ১৯৫২ সালের এ দিনে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউরসহ অনেকে আত্মাহুতি দিয়ে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। বাংলাকে পথ চলার সম্বল করে বাধা পেরোনোর শপথের দিন আজ। দিনটি বাঙালি জাতির জন্য একই সঙ্গে শোক ও গৌরবের। কেবল বাঙালির নয়, দিবসটি বিশ্বের সব ভাষাভাষী মানুষের। তাই বাঙালিসহ বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ সেই শহীদদের আজ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে।
“ওরা আমার মুখের ভাষা কাইরা নিতে চায়
ওরা কথায় কথায় শিকল পরায় আমার হাতে-পায়ে
ওরা আমার মুখের ভাষা কাইরা নিতে
কইতো যাহা আমার দাদায়, কইছে তাহা আমার বাবায়
এখন কও দেহি ভাই মোর মুখে কি অন্য কথা শোভা পায়।”
আটষট্টি বছর কেটে গেল দেখতে দেখতে। দিনটা ছিল ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন ১৩৫৮) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক ছাত্র ও প্রগতিশীল কিছু রাজনৈতিক কর্মী মিলে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। মিছিল যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে নিহত হন রফিক ,সালাম, এম. এ. ক্লাসের ছাত্র বরকত ও আব্দুল জব্বার সহআরও অনেকে। এছাড়া ১৭ জন ছাত্র-যুবক আহত হয়। শহীদদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়ে ওঠে। শোকাবহ এ ঘটনার অভিঘাতে সমগ্র পূর্ব বাংলায় তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে এ আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করলেও এর শুরু হয়েছিল বহু আগে, এর প্রতিক্রিয়া এবং ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান অধিরাজ্য ও ভারত অধিরাজ্য নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়।গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিকে সামনে রেখে শামসুল হক, শাসসুদ্দীন আহমেদ, শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ ছাত্র নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে গঠিত হয় ‘পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ’। ভাষার প্রশ্নে গণতান্ত্রিক যুবলীগের প্রস্তাব ছিল, ‘বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হউক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে তানিয়ে আলাপ-আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার জনসাধারণের উপর ছেড়ে দেয়া হোক এবং জনগণের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গৃহীত হোক। সে সময় রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদরা যে ভূমিকা পালন করেছিলেন, তার চেয়ে বহুগুণ বেশি ভূমিকা পালন করেছিল প্রগতিশীল ছাত্রসমাজ। তারা বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে সকল ষড়যন্ত্র রুখে দেন এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তোলেন।
পাকিস্তানের ছিল দু’টি অংশ: পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান। পাকিস্তানের দুটি অংশের মধ্যে সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও ভাষাগত দিক থেকে অনেকগুলো মৌলিক পার্থক্য বিরাজমান ছিল। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান অধিরাজ্য সরকার ঘোষণা করে যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এ ঘোষণার প্রেক্ষাপটে পূর্ব বাংলায় অবস্থানকারী বাংলাভাষী সাধারণ জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভের জন্ম হয় ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। পূর্ব বাংলার বাংলাভাষী মানুষ আকস্মিক এ সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি এবং মানসিকভাবে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ফলস্বরূপ বাংলাভাষার সম-মর্যাদার দাবিতে পূর্ব বাংলায় আন্দোলন দ্রুত দানা বেঁধে ওঠে। আন্দোলন দমনে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে মিছিল, সমাবেশ ইত্যাদি বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
ছাত্র-জনতার মিছিলেও পুলিশ অত্যাচার-নিপীড়ন চালায়। এ নির্লজ্জ, পাশবিক, পুলিশি হামলার প্রতিবাদে মুসলিম লীগ সংসদীয় দল থেকে সেদিনই পদত্যাগ করেন। ভাষা আন্দোলনের শহীদ স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার জন্য মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গনে রাতারাতি ছাত্রদের দ্বারা গড়ে ওঠে শহীদ মিনার।গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং ১৯৫৪ সালের ৭ই মে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত হয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে ২১৪ নং অনুচ্ছেদে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লিখিত হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা হয়। বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৭ সালে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন জারি করে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো বাংলা ভাষা আন্দোলন, মানুষের ভাষা এবং কৃষ্টির অধিকারের প্রতি সম্মান জানিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন।
সম্প্রতি প্রকাশিত এক জরিপে দেখা গেছে, লন্ডনে প্রচলিত তিনশতাধিক ভাষার মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম ভাষা হচ্ছে ‘বাংলা’। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসামসহ সারা বিশ্বে বর্তমানে ২৫ কোটিরও বেশি লোকের মাতৃভাষা ‘বাংলা’।
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো ২১শে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি? হ্যাঁ ঠিক কোন বাঙালির ভোলা উচিৎ নয় এই তারিখ, যেদিন ঢাকার রাজপথে রক্ত ঝরিয়েছিলেন বাঙালি তরুণ তরুণী। তাঁরা তাঁদের রক্ত দিয়ে লিখেছিলেন বাংলা ভাষার নতুন ইতিহাস। ২১শে ফেব্রুয়ারি আমাদের আত্মমর্যাদাশীল করে। ২১শে মানে মাথানত না করা। আর এইদিনটা শুধুমাত্র বাঙলীদের জন্যই নয় এই দিনটা প্রত্যেক মানুষের তাঁর মাতৃভাষার প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা জানানোর দিন। ১৯৫২-এর ২১শে ফেব্রুয়ারির সংগ্রামের জন্য। মোদের গোরব, মোদের আশা
আ – মরি বাংলা ভাষা।।।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে ভাষা আন্দোলনের মহান শহীদদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শ্রদ্ধা নিবেদন।
Facebook Comments