জিলিপি ঘিরেই জমে উঠেছে হাড়দার প্রাচীন লক্ষ্মীপূজা। অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার প্রাচীন ও আকর্ষণীয় লক্ষ্মী পূজাগুলির মধ্যে অন্যতম হলো ঝাড়গ্রাম জেলার বিনপুর-২ ব্লকের হাড়দা গ্রামের সর্বজনীন লক্ষ্মী পূজা। আর পাঁচদিন ধরে চলা লক্ষ্মী পূজা এবং তাকে কেন্দ্র করে চলা মেলা হাড়দা বাসীদের কাছে শারদোৎসবের আসল আনন্দ বয়ে আনে। বিউলির ডালের সাথে আতপ চালের গুঁড়া মিশিয়ে বিশেষভাবে তৈরি জিলিপি এখানকার লক্ষ্মী পূজার বিশেষ আকর্ষণ। এই জিলিপির টানে প্রায় প্রতিদিনেই লক্ষ্মী পূজায় ছুটে আসেন হাজার হাজার মানুষ। পূজা উপলক্ষে প্রায় দু’শো কুইন্টাল জিলিপি বিক্রি হয় বলে জানান গ্রামের বাসিন্দা শিক্ষক সৌমেন মন্ডল। মানুষের বিশ্বাস, এই জিলিপিতে মিশে থাকে দেবীর আশীর্বাদ। এই পূজার অপর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো কোজাগরী পূর্ণিমায় এখানে শুধুমাত্র লক্ষ্মীদেবী নন, লক্ষ্মীর সাথে সরস্বতীর দেবীর আরাধনাও করা হয়। এরই সাথে পূজিত হন নারায়ন ও চারজন সখী। সখীরা লুকলুকানী নামে পরিচিত। এবারে পূজার ১৫৭ তম বছরে পা দিলো। পূজার বাজেট প্রায় কয়েক লক্ষ টাকা। পূজা উপলক্ষ্যে দুই দিন কলকাতার যাত্রাদলের যাত্রাপালাগান সহ পাঁচদিন ধরে চলছে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। পাশাপাশি অনুষ্ঠিত হচ্ছে নানা ধরনের আকর্ষণীয় ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা। শুধু হাড়দা বা পাশাপাশি এলাকার মানুষ নন, অনেক দূরদূরান্ত থেকে বহু মানুষ এখানে পূজা এবং পূজাকে কেন্দ্র করে বসা মেলা দেখতে আসেন।
কিংবদন্তী ও জনশ্রুতি অনুসারে স্বপ্নাদেশ পেয়ে হাড়দা গ্রামের মোড়ল হিসেবে পরিচিত মন্ডলদের পূর্বপুরুষ অক্রুর মন্ডল ১৮৬২ খ্রীস্টাব্দে পারিবারিক ভাবে এই পূজা শুরু করেন। তখন মন্ডলরা ছিলেন সংখ্যায় চল্লিশ ঘর মতো। সেই মন্ডল “বাকুল”এর সংখ্যা এখন অনেক বেড়েছে। তাঁরা এখন প্রায় চারশো ঘর। পাশাপাশি পূজায় যোগ দিয়েছেন গ্রামের অন্যান্য বাসিন্দারাও। তবে পূজার মূল দায়িত্ব পালন করেন মন্ডলরাই। আগে খড়ের ছাউনির মাটির ঘরে পূজা হতো। বছর সাতেক আগে পাকা মন্দির তৈরি হয়েছে। প্রতিবছর একচালার কাঠামোর উপর প্রতিমা তৈরি হয় লক্ষ্মীর বাঁদিকে থাকেন সরস্বতী তাদের দু’পাশে থাকেন চারজন সখী। সবার উপরে থাকেন নারায়ণ। লক্ষ্মী-সরস্বতী একসাথে পূজা করার কারণ খুঁজতে গিয়ে পুজো কমিটির উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে জানা গেল, বিষ্ণু পুরাণ অনুযায়ী নারায়ণের দুই স্ত্রী লক্ষ্মী ও সরস্বতী। সে কারণে এখানে দুই স্ত্রীর সঙ্গে নারায়ণ পূজা করা হয়। বংশ পরম্পরায় নির্দিষ্ট ব্রাহ্মণ পরিবার এখানে পূজা করেন। দেব-দেবীদের চিরাচরিত অন্নভোগের পাশাপাশি লুচি, সুজি, নাড়ু নিবেদন করা হয়। এখানে পূজার খরচ গ্রামের মানুষরাই জোগান। বাইরের কারোও কাছ থেকে সেভাবে চাঁদা নেওয়া হয় না। নিলামের মাধ্যমে এখানকার প্রসিদ্ধ জিলিপি বিক্রি করার অনুমতি পায় কোন একটি নির্দিষ্ট দোকান। পূজা কমিটির সূত্রে জানা গেছে এবারে সর্বোচ্চ ১লক্ষ ১০ হাজার টাকা দর দিয়ে জিলিপি দোকান করার অনুমতি পেয়েছেন জনৈক রাজেশ মন্ডল।
কোজাগরীর সন্ধ্যায় এলাকার পুরুষ ও মহিলারা একসঙ্গে শঙ্খধ্বনি ও হরিনাম সংকীর্তন সহযোগে গ্রামের মন্ডল দিঘির ঘাটে জল ভরতে যান। এই দিঘিতে প্রতিবছর হয় আতশবাজির প্রদর্শন। এ বছরের নতুন ধরনের আতশবাজির খেলা তাক লাগিয়ে দেয় উপস্থিত মানুষদের। পূজা এই পাঁচটি দিনকে বর্ণময় ও আকর্ষণীয় করে তুলতে চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি পূজা কমিটির সম্পাদক সুপ্রিয় মন্ডল, সভাপতি প্রদীপ কুমার মন্ডল সহ অন্যান্য কর্মকর্তারা।
ছবি সৌজন্যে – সৌমেন মন্ডল
Facebook Comments