আগামী বছরেই লোকসভা ভোট। আপাতত সেই দিকেই চোখ করে ঘুঁটি সাজাতে ব্যস্ত দেশের শাসক বিরোধী সব পক্ষই। লোকসভা ভোটের আগে নিজেদের ঘর ভালোভাবে সাজিয়ে নিতে ব্যস্ত সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলিই। এক্ষেত্রে বিজেপির তাগিদটা বোধকরি একটু বেশিই। এর কারণ পর্যালোচনা করতে গেলে তিনটি কারণ প্রধানত উঠে আসে, প্রথম কারণটি হল, কেন্দ্রে মোদী সরকারের চার বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরেও দেশে অসহিষ্ণুতা, সাম্প্রদায়িক উস্কানি, নোটবন্দী, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মুল্যবৃদ্ধি, পেট্রোল ডিজেলের লাগামছাড়া দাম, সবকিছু মিলিয়ে জনমানসে এই সরকারের প্রতি একটি বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। সাম্প্রদায়িক ইস্যুকে বারবার সামনে এনে প্রকৃত উন্নয়নের থেকে মানুষের মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার এই খেলায় আমজনতা একপ্রকার তিতিবিরক্ত। যা মোদী, অমিত শাহরা বিলক্ষণ টের পেয়েছেন। দ্বিতীয় কারণটি হল, দেশের সাম্প্রতিক কিছু উপনির্বাচনের ফল। গত কয়েক মাসে দেশে ঘটে যাওয়া একাধিক লোকসভা এবং বিধানসভা আসনের উপনির্বাচনে গেরুয়া শিবির পরাজয়ের মুখ দেখেছে। যার জেরে ইতিমধ্যেই লোকসভায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের মর্যাদা হারিয়েছে নরেন্দ্র মোদীর দল। এই ঘটনায় প্রমাণ গুনেছেন বিজেপি নেতৃত্ব। তৃতীয় কারণটি হল বিরোধীদের ঐক্যবদ্ধ লড়াই। দেশের প্রায় সবকটি উপনির্বাচনে বিরোধী দলগুলি একত্রিত ভাবে মোকাবিলা করে বিজেপিকে হারের মুখে ঠেলে দিয়েছে। নিজেদের মধ্যেকার সমস্যাকে দূরে সরিয়ে রেখে বিজেপি বিরোধী দলগুলি জোট বাঁধছে। কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে জেডিএস নেতা কুমারস্বামীর শপথ নেওয়ার মঞ্চেই বিরোধীদের এক হয়ে লড়ার ডাক শোনা গিয়েছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে সীতারাম ইয়েচুরি, অখিলেশ যাদব থেকে মায়াবতী যুযুধান সমস্ত বিরোধী দলগুলির নেতারা সেদিন পরস্পরের হাতে হাত মিলিয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে এক হয়ে লড়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। যেই জোটশক্তির এক অন্যতম কারিগর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতার প্রস্তাবিত ফেডারেল ফ্রন্ট আদৌ হবে নাকি কংগ্রেসের নেতৃত্বেই সমস্ত বিরোধী দলগুলি আগামী লোকসভা ভোটে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই করবে, তা জানতে এখনো কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে বৈকি। কিন্তু তার আগেই, বিরোধীদের এই জোটকে মাঠে মারার পরিকল্পনা ইতমধ্যেই করতে শুরু করে দিয়েছেন গেরুয়া শিবিরের চাণক্য। তাই লোকসভা ভোট জত এগিয়ে আসছে আঞ্চলিক বিরোধী দলগুলির প্রতি সুর তত চড়াচ্ছেন বিজেপি নেতারা। এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃনমূল কংগ্রেস তাদের বকলমে প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতীয় রাজনীতিতে নরেন্দ্র মোদীকে টেক্কা দেওয়ার মতো নেত্রী একমাত্র মমতাই আছেন বলে মত রাজনৈতিক মহলের। যেভাবে বারবার নানা ইস্যুতে তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা মোদী সরকারের বিরোধিতা করেছে, তাতে মমতাকেই বিরোধীদের মুখ হিসেবে দেখছেন অনেকেই। তাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর তাঁর দলের বিরুদ্ধে এবার অলআউট ঝাঁপাচ্ছে তৃনমূল। মাত্র অল্প কয়েকদিনের ব্যবধানে বর্তমান বিজেপির সবথেকে বড় দুই শক্তি অমিত শাহ এবং নরেন্দ্র মোদীর এরাজ্য সভা করতে আসা বিজেপির অল আউট ঝাঁপানোরই ইঙ্গিত দিয়েছে। গত কয়েক বছরে কোমায় চলে যাওয়া সারদা-নারদা মামলায় আবার হঠাৎ করে প্রাণ ফিরে আসাও সেই দিকেই ইঙ্গিত দেয়। গত মাসেই রাজ্য সফরে এসে পুরুলিয়ার জনসভা থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে এই বাংলার মাটি থেকে উৎখাতের ডাক দিয়েছিলেন অমিত শাহ। তারপর গতকাল মেদিনীপুরে ‘কৃষক কল্যান সমাবেশ’এ যোগ দিয়ে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সরকারের তীব্র আক্রমণ করলেন প্রধানমন্ত্রী। এদিনের মঞ্চ থেকেই লোকসভা ভোটের দামামা বাজিয়ে দিলেন মোদী। পঞ্চায়েত নির্বাচনে সন্ত্রাস থেকে শুরু করে রাজ্যে সিন্ডিকেটের বাড়বাড়ন্ত সবকিছু নিয়ে তৃনমূল সরকারকে বারবার তুলোধোনা করলেন প্রধানমন্ত্রী। এদিনের সভা থেকে মোদী বলেন, “এই রাজ্য সিন্ডিকেটের আঁতুড়ঘরে পরিণত হয়েছে। কৃষক তার ফসল কোথায় বিক্রি করবে তা সিন্ডিকেট ঠিক করবে, কত টাকায় বিক্রি করবে সেটাও সিন্ডিকেট ঠিক করবে, সিন্ডিকেট সেখান থেকে কত টাকা নেবে সেটাও ঠিক করবে সিন্ডিকেট। এমনকি কলেজে ভর্তি হতে গেলেও সিন্ডিকেটকে না টাকা দিলে ভর্তি হওয়া যায় না”। গত পঞ্চায়েত ভোটের হিংসার উল্লেখ করে মোদী বলেন, “আমাদের একের পর এক দলিত নেতাদের খুন করা হয়েছে। তাদের নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু তারপরেও সন্ত্রাস এবং হিংসাকে উপেক্ষা করে মানুষ যেভাবে বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন তার জানি আমি আপনাদের কৃতজ্ঞতা জানাই”। এছাড়াও এদিন আরও একাধিক ইস্যু নিয়ে তৃনমূল কংগ্রেসকে খোঁচা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। রাজ্য বিজেপি নেতৃত্বর দাবি মতো গেরুয়া শিবির বাংলায় ২২ টি লোকসভা আসন পাবে কিনা তা সময় বলবে। কিন্তু বিনা লড়াইয়ে বিজেপি যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলকে এতটুকুও জায়গা ছেড়ে দেবে না তার ইঙ্গিত এদিনের ‘কৃষক কল্যাণ সমাবেশ’ এর মঞ্চ থেকেই দিয়ে গেলেন নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী।
ছবি সৌজন্যে- দিলীপ ঘোষ ফেসবুক পেজ
Facebook Comments