মেদিনীপুরের সাংস্কৃতিক ইতিহাস আরও একটি গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা হচ্ছে সোমবার। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে মেদিনীপুর জেলা তথা মেদিনীপুর শহর যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে তেমনি বাংলা তথা দেশের সংস্কৃতির প্রসারের ক্ষেত্রেও মেদিনীপুরের অবদান কম নয়। এক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে মেদিনীপুরের সংস্কৃতিকে যে সমস্ত সংস্থা এগিয়ে নিয়ে চলেছেন তার মধ্যে অগ্রণী সংস্থা মেদিনীপুরের “রবীন্দ্র স্মৃতি সমিতি” এবং তাদের নিজস্ব প্রেক্ষাগৃহ রবীন্দ্র নিলয়। মেদিনীপুর শহরের সাথে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের যোগাযোগটা অনেক পুরনো। রাজনারায়ণ বসুর বড় মেয়ে তথা অরবিন্দ ঘোষের মা স্বর্ণময়ীদেবীর বিবাহ উপলক্ষ্যে মেদিনীপুরে এসেছিলেন ব্রাহ্ম সমাজের নেতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। আর মেদিনীপুর শহরে বিদ্যাসাগর হলের দ্বারোদ্ঘাটন করতে মেদিনীপুর শহরে আসেন রবীন্দ্রনাথ। সেটা ১৯৩৯ সালের ডিসেম্বরে মাসের কথা। সে সময় আরও অনেক গুণীজন এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথের সাথে। এসেছিলেন ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার, প্রথিতযশা অধ্যাপক তথা রবীন্দ্রনাথের বিশেষ সহযোগী ক্ষিতিমোহন সেন, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, অমিয় চক্রবর্তী, নলিনী কান্ত সরকার সহ অন্যান্য বিশিষ্ট জনেরা।বিদ্যাসাগর স্মৃতি মন্দিরের সেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের চাঁদের হাটে সভাপতিত্ব করেন তৎকালীন জেলা শাসক বিনয় রঞ্জন সেন।
রবীন্দ্রনাথের এই মেদিনীপুর আগমনকে স্মরণীয় করে রাখতে গড়ে ওঠে রবীন্দ্র স্মৃতি সমিতি। ১৯৪৪ সালের ২৭শে আগষ্ট রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের তিনবছর পর তৎকালীন গুহরায় ভবনে (কর্মচারী ভবন) মেদিনীপুর শহরের সংস্কৃতিমনস্ক কিছু বিশিষ্টজন গড়ে তোলেন রবীন্দ্র স্মৃতি সমিতি। সমিতির লক্ষ্য ছিল কবির প্রয়াণের পর যাতে কবির স্মৃতি মেদিনীপুরের মানুষের মনে চিরন্তন হয় আর রবীন্দ্রনাথের মেদিনীপুরে আগমন যাতে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকে। সমিতির উদ্যোগে রবীন্দ্র নিলয় তৈরি হতে সময় লাগলো আরও ১৬ বছর। সেই সময় মেদিনীপুর কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক হয়ে আসেন সঙ্গীতপ্রেমী ও সঙ্গীত শিল্পী অমূল্যভূষন সেন। সংস্কৃতিমনা এই অধ্যাপক অল্পদিনের মধ্যেই জড়িয়ে পড়েন রবীন্দ্র স্মৃতি সমিতির কর্মকাণ্ডে। অল্পদিনের মধ্যেই সমিতির অনেকেই অনুভব করেন সমিতির নিজস্ব সভাগৃহের প্রয়োজনীয়তা। আধ্যপক সেন ও আইনজীবী সুধাংশু মিত্রসহ অন্যান্য বিশিষ্ট জনেরা উদ্যোগী হন সভাগৃহ নির্মাণে। সভাগৃহের অর্থ সংস্থানের জন্য অন্যান্যদের সহযোগিতায় অধ্যাপক সেনের বিশেষ অংশগ্রহণে বিদ্যাসাগর হলে অনুষ্ঠিত হয় রবীন্দ্র নাটকের বিশেষ শো। শো দেখতে আসেন সস্ত্রীক জেলাশাসক তথা প্রশাসনের অনেকেই। এরপর জমির জন্য অনুরোধ করা হয় প্রশাসনের কাছে। ১৯৪৭ সালে প্রথম দফায় ১০ কাঠা জমি পাওয়া যায় প্রশাসনের কাছ থেকে। দ্বিতীয় দফায় ১৯৫৯ সালে আরো ১০ কাঠা জমি পাওয়া যায় প্রশাসনের কাছ থেকে। গড়ে উঠতে থাকে সভাগৃহ। ১৯৬০ সালে গড়ে ওঠে রবীন্দ্র নিলয় সভাগৃহ। অধ্যাপক ক্ষিতিমোহন সেনের পরামর্শে সভাগৃহের প্রবেশ দ্বার তৈরি করা হয় সাঁচীস্তুপের আদলে। প্রেক্ষাগৃহ তো তৈরি হলো, কিন্তু নাম কী হবে ? সমিতির সদস্যরা শরণাপন্ন হলেন ক্ষিতিমোহন সেনের। রবীন্দ্রনাথের আঁকা একটি ছবির নিয়ে ক্ষিতিমোহন সেনের সাথে কবির কথোপকথনের অনুসঙ্গ টেনে অধ্যাপক ক্ষিতিমোহন সেনের সভাগৃহের নামকরণ করেন ‘রবীন্দ্র নিলয়’। সরকারি সাহায্য ছাড়াই পশ্চিমবঙ্গে প্রতিষ্ঠিত রবীন্দ্র সভাগৃহের নাম ‘রবীন্দ্র নিলয়’। কলকাতার রবীন্দ্র সদনও তৈরি হয়েছে এর পরে। সাতের দশকে প্রখ্যাত রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী জয়ন্ত সাহা শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী থেকে পাশ করে মেদিনীপুরে এসে রবীন্দ্র নিলয়ের সঙ্গীত শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর রবীন্দ্র নিলয়ে রবীন্দ্র চর্চা এক অন্য গতি লাভ করে সাতের ও আটের দশকজুড়ে।
নানা চড়াই-উৎরাই অতিক্রম করে এই আগষ্টেই ৭৫ বছরে পা রাখছে রবীন্দ্র স্মৃতি সমিতি। সারাবছর ধরে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ৭৫ বছর পালিত হবে। এবিষয়ে রবীন্দ্র স্মৃতি সমিতির সভাপতি জগবন্ধু অধিকারী, সাধারণ সম্পাদক লক্ষণচন্দ্র ওঝা, সাংস্কৃতিক সভাপতি জয়ন্ত সাহা, সাংস্কৃতিক সম্পাদক হায়দার আলিসহ অন্যান্যদের নেতৃত্বে নানা অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে সময়ের সাথে সাথে রবীন্দ্র নিলয় ভবনের কিছু ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে। ভবনটির আশু সংস্কার প্রয়োজন। ছাদ থেকে জল চুঁইয়ে পড়ার একটা সমস্যা আছে। কোথাও, কোথাও অল্প হলেও পলেস্তারা খসে পড়েছে। রয়েছে পরিকাঠামোগত নানা সমস্যা। গ্রীণরুম সংলগ্ন শৌচাগারের অভাব রয়েছে। সমিতির সাধারণ সম্পাদক লক্ষণ চন্দ্র ওঝা জানান, ছাদটির দ্রুত সংস্কার প্রয়োজন এবং তাঁরা এ বিষয়ে প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েছেন। এই রবীন্দ্র নিলয় মেদিনীপুর শহর তথা জেলার একটি অমূল্য সম্পদ। এত কম ভাড়ায় প্রেক্ষাগৃহ পাওয়া মেদিনীপুর শহরে কঠিন বিষয়। এই সম্পদকে রক্ষা করতে সমস্ত শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের এগিয়ে আসা আশু প্রয়োজন।
ছবি – রবীন্দ্র নিলয় কর্তৃপক্ষ ও সুদীপ কুমার খাঁড়ার সৌজন্যে
Facebook Comments