চোখের কোনে লুকানো জল। মনের অতলে না বলা অনেক কথা। এরই মাঝে মৃত্যুর ডাক। তখন সারা সেট জুড়ে গ্রাস করত নিবির স্তব্ধতা। এরপরেই শোনা যেত “কাট”। উনিশে এপ্রিল, দোসর, আবহমান এ এমন দৃশ্য বারবার এসেছে। কয়েক বছর আগে লেক গার্ডেনসে এ তাঁর বাড়ি ঘিরে ছিল এমন নীরবতা। তবে পরিচালকের সেই নির্দেশ আর শোনা গেল না। তিনি ঘুমের মধ্যেই যে চিরনিদ্রায় নিদ্রিত। ঘরের ঠাণ্ডা আবহাওয়ার সঙ্গে তাঁর শরীর টাও যে এক হয়ে গেছে। তাঁর মৃত্যুতে ঋতুহীন হয়ে পড়ল চলচ্চিত্র জগত।
“বাঙালি যে মৃত্যুকে বড্ড ভালোবাসে”। তিনি জানতেন এটা। তাই তাঁর স্ক্রিপ্টে মৃত্যুর দৃশ্য আবেগের জালে বুনত চিত্রপরিচালক। একজন মানুষ কখনও সহ্য করেছে অপমান। আবার কখনও একের পর এক সম্মান চুপ করিয়ে দিয়েছে সেই মুখ গুলোকে। তিনি বরাবর বিশ্বাস করতেন কাজই পারে অপমানের যোগ্য উত্তর দিতে।
বয়স তখন চব্বিস-পঁচিশ। বিশ্ববিদ্যালয় কে সবে পিছনে ফেলে চাকরির খোঁজে ঢুঁ মারছেন। কিন্তু কপালে তখন শুধুই অসম্মান। শেষে বিজ্ঞাপন তৈরির এজেন্সি “ রেসপন্স” দিল। মাসে ৫০০ টাকার বিনিময়ে শিক্ষানবিশ কপিরাইটারের কাজে হাতেখড়ি। তিনি ভরসা রেখেছিলেন নিজের উপর। দু বছরের মধ্যে আরেক সংস্থা “মুদ্রা” এলো তাঁর কাছে। বেতন দশ হাজার টাকা। এরপর বিজ্ঞাপন জগতের অন্যতম কিংবদন্তি তখনকার সময়ে তাঁর বস রাম রে কে বলেছিলেন “বাজারে আমার এই দাম তা তো আপনি স্বীকার করেননি।”
স্পষ্ট বক্তা ছিলেন তিনি। সাহিত্য মিশে ছিল রন্ধ্রে রন্ধ্রে। তাঁর বিরুদ্ধে যে কোন রকম বিরোধিতাকে মনোযোগ দিয়ে গ্রহণ করতেন। চেষ্টা করতেন বোঝার সেটা কি সত্যিই বিরোধিতা করার মত।
সেই চিত্রপরিচালক, অভিনেতা, লেখক, বন্ধু, মানুষ ঋতুপর্ণ ঘোষকে শেষবারের মত দেখতে ভিড় জমিয়েছিল অগনতি মানুষ। জ্যৈষ্ঠের সকালে এইভাবে ঋতুপতন সত্যিই অবিশ্বাস্য।
সাউথ পয়েন্ট স্কুল তাঁর জীবন শুরু। এরপর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে স্নাতক হন তিনি। তবুও লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশন হাতছানি দিতে থাকে তাঁকে। হিরের আংটি, দোসর, অন্তর মহল, তিতলি,অসুখ, উৎসব, শুভ মহরৎ, খেলা, সত্যান্বেষী। একের পর এক ঋতু প্রাপ্তি আমাদের।
” মেঘ পিয়নের ব্যাগের ভেতর মন খারাপের দিস্তা
মন খারাপ হলে কুয়াশা হয় ব্যাকুল হলে তিস্তা।”
মন খারাপ করা এই লাইন যে আজ শুধুই ইতিহাস। চলচ্চিত্রের ব্যবসার দিক আর সাহিত্যের মেলবন্ধন ঘটিয়ে তিনি তৈরি করেছিলেন নিজের ঘরানা। ১২ বারের জাতীয় পুরস্কার জয়ী এই হিরের আংটি যে হারিয়ে গেল।
বিজ্ঞাপন দিয়েই কর্মজীবন শুরু। জীবনটাও হয়ে রইল বিজ্ঞাপনের গল্প। সংক্ষেপ অথচ সফল। প্রচারের আলোয় ছিলেন সবসময়। বিতর্ক হোক বা জাতীয় পুরুস্কার। তাঁর এই চলে যাওয়ায় “তাসের ঘর” যে ভেঙ্গেই পড়ল। টুকরো টুকরো স্মৃতি আর চলচ্চিত্রে দেওয়া অবদান নতুন কোলাজে ফ্রেম বন্দি হয়ে রইল সকলের মনে।
Facebook Comments