রথযাত্রা মানেই জগন্নাথদেবের মাসির বাড়ি যাত্রার উৎসব। বছরের পর বছর ধরে রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে মানুষের উৎসাহ উদ্দীপনার এতটুকু ঘাটতি হয়নি। শ্রীক্ষেত্র পুরীর রথযাত্রার মতোই বাংলার বিভিন্ন প্রান্তের রথযাত্রা ও তার ইতিহাস বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলার প্রাচীনতম রথের মধ্যে হুগলির শ্রীরামপুরের মাহেশ, হুগলির গুপ্তিপাড়ার বৃন্দাবনচন্দ্রের রথের পাশাপাশি পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদল রাজবাড়ির গোপাল জিউর রথ প্রসিদ্ধ। বাংলার সর্বাধিক প্রসিদ্ধ এই রথগুলি সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করা হলো।
শ্রীরামপুরের মাহেশের রথ
ওডিশার পুরীর পর ভারতের দ্বিতীয় প্রাচীনতম এবং বাংলার প্রাচীনতম রথযাত্রা উৎসব শ্রীরামপুরের মাহেশ। ছ’শো বছরেরও বেশি পুরনো শ্রীরামপুরের মাহেশের রথ। ১৭৫৫-এ কলকাতার নয়নচাঁদ মল্লিক মাহেশে জগন্নাথ দেবের মন্দির তৈরি করেছিলেন। বর্তমান রথটি প্রায় ১৩১ বছরের পুরনো। সে সময় ২০ হাজার টাকা ব্যয়ে শ্যামবাজারের বসু পরিবারের সদস্য হুগলির দেওয়ান কৃষ্ণচন্দ্র বসু রথটি তৈরি করিয়ে দিয়েছিলেন। রথটিতে রয়েছে মোট ১২টি লোহার চাকা এবং ২টি তামার ঘোড়া। ইতিহাস বলে সাধক ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী স্বপ্ন পেয়ে গঙ্গায় ভেসে আসা নিমকাঠ দিয়ে দারুমূর্তি তৈরি করেন। প্রতি বছর রথের আগে বিগ্রহের অঙ্গরাগ হয়ে থাকে। রথযাত্রার দিন মাহেশ জগন্নাথ দেবের মূল মন্দির থেকে মাহেশেরই গুন্ডিচা মন্দির অর্থাৎ মাসীরবাড়ী অবধি জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার সুবিশাল রথটি স্থানীয় জিটি রোড ধরে টেনে নিয়ে যাবেন পুণ্যার্থীরা। এই রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে আজও একমাস ধরে বসে মেলা। অসংখ্য মানুষের সমাগম ঘটে। উল্লেখযোগ্য, বঙ্কিমচন্দ্রের ‘রাধারাণী’ উপন্যাসের প্রেক্ষাপট ছিল এই মাহেশের রথযাত্রা।
হুগলি জেলার গুপ্তিপাড়ার রথযাত্রা
মাহেশের পরই বাংলার প্রাচীন রথগুলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হুগলি জেলারই গুপ্তিপাড়ার রথযাত্রা। অনেকে গুপ্তিপাড়াকে গুপ্তবৃন্দাবন মনে করেন। এখানেই রয়েছেন শ্রীবৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দির। বৃন্দাবন জিউর মন্দিরেই থাকেন জগন্নাথ। শোনা যায়, স্বপ্নাদেশ পেয়ে ১৭৮৪-এ জগন্নাথদেবের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন স্বামী মধুসূদনানন্দ। সেই থেকেই রথযাত্রার প্রচলন। ন’টি চূড়াবিশিষ্ট এই রথে থাকে নানা রঙের আকর্ষণীয় পতাকা। একটি সাদা ও নীল ঘোড়া ছা়ড়াও থাকে সারথি এবং আরও কয়েকটি কাঠের পুতুল। এখনও অসংখ্য ভক্ত সমাগম হয় এই উপলক্ষে। তবে রথের আরও এক আকর্ষণ ভাণ্ডার লুঠ।
মহিষাদলের রথ
পূর্ব মেদিনীপুরের মেচেদা-হলদিয়া সড়ক পথে অবস্থিত মহিষাদল। মহিষাদল রাজবংশের পৃষ্ঠপোষকতায় মহিষাদলের রথ ২৪২ বছর ধরে আজও তার ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। মহিষাদলের জমিদার বংশের রাজা আনন্দলালের স্ত্রী রানি জানকীর উৎসাহে ১৭৭৬ সালে রথযাত্রার শুরু হয়। অত্যন্ত ধর্মপরায়ণা রানি জানকী এই রথযাত্রার প্রবর্তন করেন। সেই আমল থেকেই এই রথের মেলা পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম বড় এবং পূর্ব মেদিনীপুরের সব থেকে বড় মেলা হিসেবে পরিচিত। প্রথমে এই রথ ছিল ১৭ চূড়া নিয়ে। প্রতিটি চাকার উচ্চতা ছিল ছয় ফুট। সেই আমলে রথ তৈরিতে খরচ হয়েছিল ৬৪ হাজার টাকা। ধীরে ধীরে রথ ভগ্নপ্রায় হতে থাকে। গতবছর ২০১৭ তে রথটি নতুন রূপে তৈরি করা হয়। আগের ঐতিহ্যকে বজায় রেখে খরচ হয়েছে প্রায় ২৮ লক্ষ টাকা। এই রথকে ঘিরে প্রায় এক মাস ধরে মেলা চলে। আগে শুধুমাত্র মহিষাদল রাজপরিবারের সদস্যরাই রথের রশি টানতেন। এখন মহিষাদল পঞ্চায়েত সমিতি ও রাজপরিবার যৌথ উদ্যোগে রথ টানা হয়। এই রথের মেলায় কয়েক হাজার মানুষের ভিড় হয়।
ছবি – সন্দীপ কুমার পাল, স্বরূপ সামন্ত, ভিউ ফাউন্ডার্স
Facebook Comments