স্মরণীয় মুহূর্তের সাক্ষী থাকলো পশ্চিম মেদিনীপুরের ইতিহাসে প্রসিদ্ধ শহর দাঁতন। দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত বাংলার ঐতিহাসিক জনপদ দাঁতন থেকে প্রকাশিত হল আঞ্চলিক ইতিহাস, লোকসংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, চিত্র-শিল্প-ভাস্কর্য ও সাহিত্যের এক ভিন্ন ঘরানার পত্রিকা ‘দন্তভুক্তি ‘। বেহালার সুরের মূর্চ্ছনায়, অনন্তদ্বীপ প্রজ্জ্বলনের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের শুভ সূত্রপাত ঘটে। প্রথম পর্বে পত্রিকাটির আনুষ্ঠানিক মোড়ক উন্মোচন করেন বিশিষ্ট কবি ও গদ্যকার সুধীর দত্ত এবং বিশিষ্ট লোকসাহিত্যিক নলিনী বেরা। উপস্থিত ছিলেন দাঁতনের বিধায়ক বিক্রম চন্দ্র প্রধান, সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিক অনিরুদ্ধ ঘোষ, দাঁতন থানার আই.সি. সুব্রত মজুমদার, দাঁতন-১ পঞ্চায়েত সমিতির সহ-সভাপতি কনক পাত্র প্রমুখ। সভায় আগত প্রায় ১৩০ জন সম্মানীয় অতিথিকে স্বাগত জানান পত্রিকার প্রধান সম্পাদক সন্তু জানা।
‘ইতিহাসের পথে নতুন ইতিহাস’ গড়ে তোলার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে পথচলা শুরু করা এই পত্রিকার শুভ উদ্বোধন অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে একটি বিশেষ আলোচনা সভা সংঘটিত হয়। বিশিষ্ট গবেষক ডঃ মধুপ দে আলোচনা করেন ‘দন্তপুর-দন্তভুক্তি-কপিসা ও কালিদাস’- এই বিষয়ে। রবীন্দ্র গবেষক ডঃ বিবেকানন্দ চক্রবর্তী আলোচনা করেন ‘রবীন্দ্রনাথ ও লোক সাহিত্য’ বিষয়ে এবং লোকসংস্কৃতি গবেষক ভাষ্করব্রত পতি একটি মনোগ্রাহী আলোচনা করেন ‘মেদিনীপুরের কাকমারা সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রা’ শীর্ষক বক্তব্যে।
অনুষ্ঠানের তৃতীয় পর্বে কলকাতা ছাড়াও অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তথা মেদিনীপুর শহর, খড়্গপুর, কাঁথি, হলদিয়া, মোহনপুর, এগরা, বেলদা, কেশিয়াড়ী, সবং, তমলুক সহ আরো বহু দূর-দূরান্ত থেকে আগত শতাধিক কবি-সাহিত্যিক- গবেষক-চিত্রশিল্পী- আলোকচিত্রী এবং সংস্কৃতি চেতনা সম্পন্ন মানুষ ‘দন্তভূক্তি- পত্রিকার ভবিষ্যত শীর্ষক’ কথোপকথন-পর্বে তাঁদের সুচিন্তক মতামত পেশ করেন। পর্বটি পরিচালনা করেন অখিলবন্ধু মহাপাত্র। এই পর্বে কবিতা পাঠ করেন বিশিষ্ট কবি সুনীল মাজি, নিতাই বিনোদ পারিয়া, আশিষ মিশ্র, শিশির দাসগুপ্ত, বিরূপাক্ষ পন্ডা প্রমুখ। প্রতিবেশী রাজ্য ওডিশা থেকে আগত বিশিষ্ট ওড়িয়া কবি বিপিন বিহারী বিশাল বাংলা-ওড়িশা সীমান্ত এলাকার ইতিহাস ও সংস্কৃতির মেলবন্ধনের বার্তা ছড়িয়ে দেন। চিত্র-শিল্প-ভাস্কর্য ভাবনা নিয়ে শৈল্পিক ভাবনা পেশ করেন ভাস্কর্য শিল্পী সুধীর মাইতি। আবৃত্তি পরিবেশন করেন বাচিকশিল্পী বৃষ্টি মুখোপাধ্যায়। বেহালায় সঙ্গত করেন সৌরভ মিশ্র। দাঁতন-১ এর সমষ্টি উন্নয়ন কার্যালয়ের সভাগৃহে প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘন্টা ধরে এই অনিন্দ্যসুন্দর অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয়।
পত্রিকার প্রধান সম্পাদক সন্তু জানা জানান, “দন্তভুক্তি হল গৌড়রাজ শশাঙ্কের আমলের একটি প্রান্তিক রাজ্য, যার প্রধান কেন্দ্র ছিল আজকের দাঁতন। বৌদ্ধ দাঠাবংশ গ্রন্থে উল্লেখিত দন্তপুরও হল আজকের দাঁতন। তাই সেই প্রাচীন ‘দন্তভুক্তি’ নাম যখন একটি পত্রিকার নাম হয়ে দাঁড়ায় তখন পৌঁছে যাওয়া যায় অতীতে, নিজের শেকড়ে। ছুঁয়ে ফেলা যায় একটি যুগ।”
পত্রিকাটি তার ধ্রূপদী সাহিত্য ও সংস্কৃতি ভাবনা নিয়ে আগামী দিনে এই সীমান্ত এলাকার প্রতীক হয়ে উঠবে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। সমস্ত অনুষ্ঠানটি সুচারুরূপে সঞ্চালনা কালে সম্পাদক তুলে ধরেন, এই ঐতিহাসিক উদ্যোগকে সাফল্যমন্ডিত করার প্রেক্ষাপটে ‘দন্তভুক্তি’ পত্রিকা পরিবারের পক্ষ থেকে লেখক শিবশংকর সেনাপতি, চিত্রশিল্পী বরুন সাহু, তরুন কবি পবিত্র পাত্র, কবি বিন্দুভূষন দে প্রমুখ ব্যক্তির আপ্রাণ প্রচেষ্টার কথা। দন্তভুক্তি পত্রিকার পক্ষ থেকে আগামী দিনে দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত বাংলার আঞ্চলিক ইতিহাস কেন্দ্রীক একটি গ্রন্থাগার ও সংগ্রহশালা তৈরী করার প্রয়াসও শুরু হয়েছে বলে জানানো হয়। সমাপ্তিতে অনুষ্ঠানের সভাপতি সূর্য নন্দী বলেন, ‘অবিভক্ত মেদিনীপুরের সমৃদ্ধ প্রাচীন ইতিহাসের ধারক ও বাহক হিসেবে ‘দন্তভুক্তি’ পত্রিকার আত্মপ্রকাশ দাঁতন তথা সমগ্র মেদিনীপুর জেলার ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক মুহুর্ত হিসেবে বিবেচিত হবে।”
ছবি সৌজন্যঃ – সন্তু জানা
Facebook Comments