থিমের এই রমরমার যুগেও প্রাচীনত্ব ও ঐতিহ্যে অনেক পুজো নজর কাড়ে। সর্বজনীন পুজোগুলির মতো, বেশকিছু প্রাচীন নজরকাড়া পারিবারিক পুজো ছড়িয়ে রয়েছে গোটা অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলা জুড়ে। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার প্রাচীন দুর্গা পুজো গুলির অন্যতম চন্দ্রকোনা রোডের মঙ্গলপাড়ার কোলে পরিবারের পুজো। কোলে বাড়িতে মহালয়া থেকেই শুরু হয়ে যায় প্রাক্ পূজা। আজ থেকে প্রায় আড়াইশো বছর আগে কিংবদন্তী অনুসারে দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে পুজো শুরু হয়েছিল চন্দ্রকোনা রোডের মঙ্গলপাড়ার কোলে পরিবার। সেই শুরু পথচলা।
তারপর আড়ম্বর কখনও বেড়েছে, কখনও কমেছে, কিন্তু দেবী আরাধনায় কখনও ছেদ পড়েনি। কোলে পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, তাঁদের পূর্বপুরুষ দুই ভাই নবীনচন্দ্র কোলে ও রামেশ্বর কোলে প্রায় আড়াইশো বছর আগে কাঠামো সমেত একটি দুর্গা প্রতিমা বিগ্রহের স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। লোককথা অনুযায়ী পুজো শুরুর পরে নবীনবাবু উন্নতি করে অনেক জমির মালিক হয়ে যান। কোলে পরিবার ক্রমে এলাকার জমিদার হয়ে ওঠেন। ধীরে ধীরে পরিবারের সদস্য সংখ্যা বাড়তে থাকে। মূল বাড়ি ভেঙে বড় বাড়ি, মেজো বাড়ি, সেজো বাড়ি সহ চারটি বাড়ি তৈরি হয়। কোলে পরিবারের পক্ষে সুশীল কোলে, কার্তিক কোলে, গৌতম কোলেরা জানান, পুজো শুরুর সময় নবীনবাবু এক আড়া অর্থাৎ প্রায় ১৬ কুইন্টাল চাল নৈবেদ্য দিয়ে পুজো শুরু করেছিলেন। পরবর্তীকালে জমিদারী চলে গেলেও দুর্গাপুজা বন্ধ হয়নি। আড়ম্বর কমলেও পুজোর নিষ্ঠায় কমতি পড়েনি এতটুকুও। পরিমাণ কমলেও এখনও পুজোর চার দিন দেবীকে এক কুইন্টাল চাল দিয়ে নৈবেদ্য দেওয়া হয়। তবে প্রথামতো পুজোর সময় কোন বলি হয় না এখানে। পূর্বপুরুষের প্রথা অনুযায়ী, কোলে বাড়ির কুলদেবতা বিষ্ণু বিগ্রহকে মহালয়ার পুণ্য প্রাতে ঘটা করে দুর্গামন্ডপে নিয়ে আসা হয়। তারপর হয় ঘটস্থাপন। প্রতিদিন চলে নিত্যসেবা। শুরু হয়ে যায় প্রাক্ পুজো। পরিবারের প্রথা মেনে ষষ্ঠীর দিন থেকে শুরু হয় দেবীর মূল পুজো। ষষ্ঠী থেকে দশমী অন্যান্য আচার পালন করা হয় যত্ন সহকারে। পুজো পরিচালনার জন্য পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গড়া হয়েছে শ্রীদুর্গা ট্রাস্টি বোর্ড। বোর্ডের সদস্য নিমাই কোলে, নিখিল কোলেদের মতে, “পুজোর সময় পরিবারের কর্মরত সকল সদস্যই যে যেখানে থাকেন, মঙ্গলপাড়ার বাড়িতে আসেন। চলে একসাথে খাওয়া – দাওয়া – আড্ডা, তাতে এলাকার বাসিন্দারাও সামিল হন। সবমিলিয়ে গোটা এলাকার প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠে এই পরিবার।” শ্বশুর বাড়ি থেকে সপরিবারে বাপের বাড়িতে আসেন মেয়েরা। দেশ স্বাধীন হয়েছে, কোলেদের দু-একটি পরিবারের বেশ উন্নতি হয়েছে। তবে এখনও স্থায়ী দুর্গামন্ডপ তৈরী হয়নি। এখনও এখানে পুজো হয় অনাড়ম্বর ভাবেই। বিরাট মণ্ডপ, বাহারি আলো বা দেদার খাওয়াদাওয়া নয়, নিষ্ঠাভাবে দেবীর অর্চনাই কোলে পরিবারের পুজোর আসল সম্পদ। পরিবারের নবীন সদস্য অভি কোলে বলেন, “এই পুজোতে মৃৎশিল্পী, ঢাকি, নাপিত, পুরোহিত সবাই এখানে বংশানুক্রমিক ভাবেই কাজ করেন। আমাদের কোলে পরিবার পুজো পরিচালনা করলেও এই পুজো এলাকার মানুষের মনে বহন করে নিয়ে আসে এক অনাবিল আনন্দ। এলাকার বাসিন্দারা সবরকম সহযোগিতা করেন।” এই কয়েকটা দিন ভক্তি ও শ্রদ্ধার সঙ্গে সকলে মেতে ওঠে মায়ের আরাধনায়। সপরিবারে পুনরায় মায়ের বাপের বাড়িতে আগমনের জন্য প্রতীক্ষায় প্রহর গুণতে থাকে। এবারেও মহালয়ার দিন বিষ্ণু বিগ্রহকে ইতিমধ্যে মন্ডপে স্থাপন করে প্রাক্ পুজো রীতি শুরু হয়ে গেছে।
ছবি সৌজন্যেঃ অভি কোলে
Facebook Comments