নানা বয়সী চরিত্রে চলচ্চিত্রের পর্দায় উপস্থিত হয়ে একজন সফল অভিনেত্রী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন রেবেকা রউফ। বয়সের ভারে এক সময়ের অনেক নায়িকাই এখন ঠাই নিয়েছেন মা চরিত্রে। এখনকার সময়ের অভিনেত্রীদের মধ্যে ব্যস্ত ও অন্যতম সফল একজন অভিনেত্রী রেবেকা। যিনি ক্যারিয়ারের প্রথম দিকে অনেক চলচ্চিত্রেই নায়িকা হয়ে অভিনয় করেছেন। তবে বর্তমানে মা হিসেবেই প্রতিনিয়ত উপস্থিত হচ্ছেন রুপালি পর্দায়। মা চরিত্রেই যেন দারুণ ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন গুণী এই অভিনেত্রী। গুণী চলচ্চিত্র পরিচালক ইবনে মিজানের হাত ধরে ১৯৮৫ সালের দিকে রেবেকার চলচ্চিত্রে পদচারণা শুরু। ‘রাজবধূ’ চলচ্চিত্রে জুনিয়র শিল্পী হিসেবে রুপালি পর্দায় তার আগমন ঘটে। এরপর অনেক চলচ্চিত্রে জুনিয়র শিল্পী হিসেবেই কাজ করেন তিনি। তারপর শিবলী সাদিকের ‘দোলনা’, ‘দংশন’, ‘সম্মান’, ‘অচেনা’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন তিনি। একই পরিচালকের ‘অর্জন’ চলচ্চিত্রে নায়িকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন রেবেকা। এই ছবিতে তিন নায়িকার এক নায়িকা ছিলেন তিনি, অন্য দুজন ছিলেন অঞ্জু ঘোষ ও কবিতা। এতে রেবেকার বিপরীতে ছিলেন প্রয়াত নায়ক মিঠুন। পরে আজমল হুদা মিঠু পরিচালিত ‘চোর ডাকাত পুলিশ’ চলচ্চিত্রে অমিত হাসানের বিপরীতে অভিনয় করেন তিনি। এরপর শিবলী সাদিকের ‘মা মাটি দেশ’, শেখ নজরুল ইসলামের ‘চাঁদের আলো’, কাজী হায়াত-এর ‘ত্রাস’, নাদিম মাহমুদের ‘আন্দোলন’সহ আরও বেশ কিছু চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন রেবেকা। মাদারীপুরের কন্যা রাবেয়া যখন চলচ্চিত্রে অভিনয়ে মগ্ন হয়ে উঠলেন, তখন ‘রাবেয়া’ পরিবর্তন করে প্রয়াত পরিচালক শিবলী সাদিক নাম দেন ‘রেবেকা’। আড়ালে চলে যায় রাবেয়া নামটি, দর্শকের ভালোবাসায় রেবেকা নামেই পরিচিত হয়ে উঠেন তিনি। ফিরোজ আল মামুন পরিচালিত একে ফিল্মস প্রযোজিত ‘কমলার বনবাস’ চলচ্চিত্রে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন রেবেকা। এতে তার বিপরীতে ছিলেন আনোয়ার শরীফ। এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করে বেশ প্রশংসিত হন তিনি। এভাবে আরও বেশকিছু চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত নায়িকা হিসেবে অভিনয় করেন তিনি। এরপর কালাম কায়সারের একটি চলচ্চিত্রে প্রথম মা হিসেবে অভিনয় করেন তিনি। নায়ক রুবেলের মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। এরপর টানা ‘গুরুদেব’, ‘দুর্ধর্ষ’, ‘প্রেম কয়েদী’, ‘জান আমার জান’, ‘জান কোরবান’সহ আরও বেশকিছু চলচ্চিত্রে মায়ের চরিত্রে অভিনয় করে মা হিসেবেও দর্শকের মনের মধ্যে ঠাঁই করে নেন রেবেকা। শুরুর দিকের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, আমি ১৯৮৫ কিংবা ১৯৮৬ সালের দিকে শিশু শিল্পী হিসেবে কাজ শুরু করি। আমার প্রথম চলচ্চিত্র ছিলো ‘রাজবধূ’। এই ছবির পরিচালক ছিলেন ইবনে মিজান। এই ছবিতে আমি দাড়িয়ে থেকে কাজ করছিলাম এখনও মনে আছে। এরপর আরও ২/৩ বছর এভাবেই কাজ করেছি ছোট ছোট পার্ট, নাচ এগুলাই করেছি ঐ সময়ে। নব্বইতে আমি নায়িকা হই তাও তিন নায়িকার এক নায়িকা। শিবলী সাদিক পরিচালিত ‘অর্জন’ নামের এই ছবিতে আমার সাথে আরও দুই নায়িকা ছিলেন অঞ্জু ঘোষ ও কবিতা। এখানে আমার বিপরীতে ছিলেন প্রয়াত মিঠুন আর অন্য দুজন নায়ক ছিলেন আলমগীর আর রুবেল। নায়িকা হিসেবে আমার দ্বিতীয় ছবি ছিলো ‘চোরের ছেলে’। এটার পরিচালক আজমুল হুদা মিঠুন। এরপর অনেক ছবিতে নায়িকা হিসেবে কাজ করেছি। তখনকার সময়ে যারা ছিলেন তাদের সবার সাথেই কাজ করেছি। তারপর ‘মা মাটি দেশ’, ‘কমলার বনবাস’ ছবি করলাম। ঐ সময় ছবিগুলো হিট ছিলো। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত নায়িকা হিসেবে অভিনয় করেছি। ইলিয়ায় কাঞ্চন, মান্না, আলিরাজ, ইমরান, মারুফ তারপর আরও অনেকের সাথেই নায়িকা হয়ে কাজ করেছি। আমি আমার অভিনয়ের জায়গা থেকে সফল হতে পারি নি। ঐ সময়ের শাবানা, রোজিনা, কবিতা, অঞ্জু তাদের মত এতো জনপ্রিয় কিংবা হিট না হতে পারলেও ভালো ছিলাম মনে করি। তবে আফসোস তো থাকেই সবার মধ্যেই। তখন আমার সাপোর্ট ছিলো না কোন। এর চেয়ে বেশী কিছু জানিনা, আল্লাহই ভালো জানে। আমার জীবনে ঐ সফলতাটা আসে নি। কমলার বনবাস সিনেমাটা তখন যে পরিমাণে হিট হয়েছিলো আমি মনে করেছিলাম এই ছবিটা হয়তো আমার জন্য দ্বার খুলে দিবে কিন্তু আমার জীবনে সেটা আসে নি, সেটা আমার দুর্ভাগ্য। অঞ্জু ঘোষ ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ ছবির পর অনেক কাজ করতে লাগলো, জনপ্রিয়তা বাড়তে লাগলো কিন্তু আমার জন্য কিছু হলো না। তখন আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম যে এত ভালো সিনেমা দিয়েও কিছু হলো না আর কি হবে! সেই জিনিসটা তখন না পেলেও এখন অন্তত একটু সুনাম, সম্মান অর্জন করতে পেরেছি। এখন আল্লাহর রহমতে একটা ভালো পর্যায়ে আসতে পেরেছি এটার জন্য শুকরিয়া। একজন ভালো অভিনেত্রী হিসেবে যে এখন স্বীকৃতি পাচ্ছি এটা নিয়েই আমি অনেক শান্তি। আমার নায়িকা হওয়ার আশা ওরকমভাবে ছিলো না, তবে ভালো একজন অভিনেত্রী হওয়ার আশাটা আমার সবসময় ছিল। ঐ সময়ের আয়েশা আক্তার, আনোয়ারা আপা, রোজিনা ভাবী আরও যারা সিনিয়র শিল্পী ছিলেন তাদের মত একজন বড় মাপের অভিনেত্রী হওয়ার ইচ্ছা ছিলো। এখন যখন মানুষের কাছে শুনি আপনার এই ছবিটা ভালো হয়েছে, আপনার অভিনয় খুব ভালো হয়েছে তখন মনে হয় হয়তো আমি মানুষের কাছে কিছুটা হলেও জায়গা করে নিতে পেরেছি। আমার গুরু শিবলী সাদিকের কাছে আমি কৃতজ্ঞ তিনি আমাকে একজন অভিনেত্রী বানাতে পেরেছেন। উনি সুযোগ না দিলে হয়তো আজ আমি এতদূর আসতে পারতাম না। রাবেয়া থেকে রেবেকা হওয়ার গল্প প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমার গুরু শিবলী সাদিক আমাকে এই নামটা দেন। এরপর থেকে সব ছবিতেই আমার নাম রেবেকা। উনার কারণেই আমি ‘রাবেয়া’ থেকে ‘রেবেকা’ হয়েছি। কমলার বনবাস ছবির প্রযোজক তার পরবর্তী ছবিতে আমাকে নিতে চেয়েছিল। তখন ঐ ছবিতে আমার অন্য একটা নাম দিতে চেয়েছিল কিন্তু আমি সেটা চাই নি বলে আমাকে ছবিতে নেন নি তিনি। আমি বলেছিলাম ‘রেবেকা’ আমার গুরুর দেওয়া নাম এটা আমি পরিবর্তন করে আমার গুরুর মনে কষ্ট দিতে পারব না। আমি রেবেকা আছি রেবেকাই থাকবো। এইজন্য ঐ প্রযোজক আমাকে তার ছবিতে নেই নি আর। আমাকে যারা চেনে সবাই রেবেকা হিসেবেই চেনে আর একজন সু অভিনেত্রী হতে পেরেছি এতেই আমি গর্ববোধ করি। ১৯৯৭ সালের দিকে আমার বিয়ে, ছেলে হওয়ার পর একটু বিরতি নেই। আবার ২০০১ সাল থেকে কাজ শুরু করি। তখন ভাবী, কাকি, মা এই চরিত্রগুলোতে অভিনয় করি। কালাম কায়সার পরিচালিত ‘চরম প্রতিশোধ’ ছবিতে আমি রুবেল ভাইয়ের মা চরিত্রে প্রথম অভিনয় করি ২০০১ সালে। এই ছবিটির পর থেকে বলতে গেলে বেশির ভাগ ছবিতেই মা চরিত্রে অভিনয় করে আসছি। এরপর যাদের সাথে নায়িকা হিসেবে কাজ করেছি তাদেরও মা হিসেবে অভিনয় করেছি আর এখন তো শাকিব খান, সাইমন, বাপ্পি যারা আছে তাদের সবার মা হিসেবেই কাজ করছি। এখনও করে যাচ্ছি, এখন তো মা বলেই ফিক্সড। এই চরিত্রটিতেও ভালো সাড়া পেয়েছি। এখন পর্যন্ত যাদের সাথে কাজ করেছি সবার থেকেই খুব ভালো ব্যবহার পেয়েছি, এখনো পাই। আমাকে এখনো অনেকে সহসাই ‘রাবু’ বলে ডাকে। আমাদের যে শাকিব খান সেও আমাকে ‘রাবু আপা’ বলেই ডাকে। এই যে সবার এতো ভালোবাসা পাচ্ছি এটাই আমার জীবনের অনেক বড় পাওয়া। এই ফিল্মের মানুষরা আমাকে অসম্ভব ভালোবাসে আমি জানি। আমি জানি আমি যখন মারা যাবো অন্তত দুইটা হাত তুলে দুইতা চোখের পানি হলেও ফেলবে এই মানুষগুলো। এই জায়গাটা থেকে আমি অনেক অনেক ভালোবাসা পেয়েছি। তাদের কাছ থেকে যে এই ভালবাসা পাই এটাই আমার বড় পাওয়া-কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি মুছে কথাগুলো বলছিলেন রেবেকা। শিল্পীদের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, সবার সাথে আমার কাজের অভিজ্ঞতা অসম্ভব ভালো। আমি খুব শান্ত টাইপের একটা মানুষ, কথা বলতাম বুঝে শুনে। মানুষের সঙ্গে মিশতাম অল্পতেই। সিনিয়র যাদের সাথে কাজ করেছি সবার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। এখনকার যারা শিল্পী আছে তারা বুঝে না বা বোঝার চেষ্টা করে না। কিন্তু আমরা যেটা পেয়ে আসছি সেটা তো অনেক বড় ব্যাপার। অনেক বড় বড় শিল্পীদের সাথে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। আমরা সিনিয়র শিল্পীদের সাথে কাজ করতে গেলে এখনও শেখার চেষ্টা করি যেটা এখন অনেকেই করে না। ছোট থেকেও শেখার আছে বড়দের থেকেও শেখার আছে। এখনকার সময়ের কথা যদি বলি তাদের কাছেও আমি মূল্যায়ন পাই, ভালোবাসা পাই। আমি এমন একটা মানুষ যাকে কিনা ভালো না বেসে উপায় নাই।
Facebook Comments