রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন সংঘটিত হয়ে থাকতে পারে—এভাবে প্রথমবারের মতো মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লায়াং স্বীকারের পর বলেন, সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা নিপীড়নের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই।
জাপানি সংবাদমাধ্যম আশাহি শিমবুনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, নিরাপত্তা বাহিনীর একাংশ এই নিপীড়ন চালিয়ে থাকতে পারে।
তবে ওই নিপীড়নে সেনা-সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ অতীতের ধারাবাহিকতায় আবারও নাকচ করেছেন তিনি।
তিনি বলেন, সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা নিপীড়নের ‘সুনির্দিষ্ট প্রমাণ’ নেই।
শুক্রবার আশাহি শিমবুনে প্রকাশিত সেই সাক্ষাৎকারের বরাতে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স ও ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি এসব কথা জানিয়েছে।
গত ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর তল্লাশি চৌকিতে হামলার পর রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পূর্বপরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা জোরালো করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। খুন,ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও সংবাদমাধ্যম রোহিঙ্গা নিপীড়নে সেনা সংশ্লিষ্টতার আলামত পেয়েছে। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে ইন দিন গ্রামের এক গণহত্যায় সেনা-সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ হাজির করা হয়।
সবশেষ জাতিসংঘের প্রতিবেদনেও রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গণহত্যার আলামত মেলে। তা সত্ত্বেও শুরু থেকে এখন পর্যন্ত নিপীড়নে সেনা-সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করে আসছে সে দেশের সেনাবাহিনী।
আশাহি শিমবুনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে মিন অং হ্লায়াং বলেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীই যে রোহিঙ্গা নিপীড়নের ঘটনায় জড়িত, সেরকম কোনও সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই।
তিনি আরও বলেন, কোনও ধরনের প্রমাণ ছাড়া সমালোচনা করা হলে তা দেশের সম্মান ক্ষুণ্ণ করে।
মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ ধারাবাহিকভাবে রোহিঙ্গা হত্যা, ধর্ষণ ও অন্য নিপীড়নের ঘটনায় সেনা সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করে আসলেও মিন অং হ্লায়াং স্বীকার করেছেন, নিরাপত্তা বাহিনীর কিছু সংখ্যক সদস্যের এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে।
মিয়ানমার ছেড়ে পালানো রোহিঙ্গাদের উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন মিন অং হ্লায়াং।
সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, আত্মীয়দের সঙ্গে থাকা কিংবা তৃতীয় কোনও দেশে পাড়ি জমানোর উদ্দেশে তারা বাংলাদেশে পালিয়ে গিয়ে থাকতে পারে। আমি বিশ্বাস করি, কারও শিখিয়ে দেয়া কথাই তারা সবাই বলছে।
মিন অং হ্লায়াং এর এসব দাবি জাতিসংঘের প্রতিবেদন ও নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের ভাষ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক প্রধান ফিলিপ্পো গ্রান্ডি জেনেভায় সাংবাদিকদের বলেন, তিনি মিন অং হ্লায়াং এর ওই সাক্ষাৎকার দেখেননি। তবে তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, গত বছর জাতিসংঘের সঙ্গে মিয়ানমারের সমঝোতা চুক্তিতে দেশটি স্বীকার করেছে যে সহিংসতা হচ্ছে, মানুষ পালাচ্ছে এবং তাদের প্রত্যাবাসিত হওয়ার অধিকার আছে।
গত বছরের আগস্টে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞে সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্টতার কথা তুলে ধরেছিল জাতিসংঘ। প্রতিবেদনে বলা হয়, সেনাবাহিনীর সঙ্গে বেসামরিক কর্তৃপক্ষও এই নিধনযজ্ঞে ইন্ধন জুগিয়েছে।
রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চিও তার সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে এই সহিংসতা থামাতে ব্যর্থ হয়েছেন।
জাতিসংঘ জানায়, রাখাইনে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ নিয়ে মিয়ানমার সরকারের প্রত্যাখ্যান ও অস্বীকারের মাত্রায় তারা অবাক হয়েছেন। এই ঘটনায় জড়িত সেনা কর্মকর্তাদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনা উচিত বলে মন্তব্য করা হয় প্রতিবেদনটিতে। সেখানে ছয় জন সেনা কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করা হয়। যার মধ্যে ছিলেন সেনাপ্রধানও। এরপর বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক মিয়ানমারের সেনাপ্রধানকে নিষিদ্ধ করে।
মিন অং হ্লায়াং একসময় ফেসবুকেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে তার কথা বলার ঘটনা খুব বিরল।
গত বছর জাতিসংঘের অনুসন্ধানে রোহিঙ্গাদের ওপর সেনাবাহিনীর ভয়াবহ যৌন নিপীড়নের আলামত পেলেও মিয়ানমারের সেনাপ্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লায়াং এ সংক্রান্ত যাবতীয় অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছিলেন।
২০১৮ সালে জাতিসংঘ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে তিনি দাবি করেছিলেন, সেনাবাহিনী সবসময় নিয়মতান্ত্রিক। যারা আইন ভঙ্গ করে তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিই আমরা।
মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বিচারের এখতিয়ার নেই বলে বার বারই দাবি করে আসছে দেশটির কর্তৃপক্ষ।
আশাহি শিমবুনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে আবারও শোনা গেলো সে কথা। তার দাবি, মিয়ানমার রোম স্ট্যাচুতে স্বাক্ষরকারী দেশ নয়।
মিয়ানমারের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি সৃষ্টিকারী কোনও নির্দেশনা গ্রহণ করব না আমরা–বলেন মিন হ্লায়াং।
Facebook Comments