পৃথিবীর চৌম্বকীয় উত্তর মেরুর অবস্থানগত পরিবর্তনের নানা গুজব এবং তথ্য প্রমাণকে অবশেষে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে নাসার অধীনস্থ নোআ। নতুনভাবে চৌম্বকীয় উত্তর মেরুর অবস্থান শনাক্ত করার কাজটাও করে নিয়েছেন তারা। এর আগে মেরু নিকটবর্তী অক্ষাংশে চৌম্বকীয় উত্তর মেরুর বিভিন্ন পরিবর্তন বেশ কিছু বিপর্যয়ের ইঙ্গিত দিয়েছিল, বিশেষ করে দিন নির্দেশনার ক্ষেত্রে।
ভৌগলিক কারণেই বিভিন্ন সময় চৌম্বকীয় মেরুর অবস্থান পরিবর্তনজনিত প্রভাব লক্ষ করা যায়। পৃথিবীর চৌম্বক মেরু মূলত মূল পৃথিবী ভূখণ্ড থেকে ১৮০০ মেইল গভীরে ক্রমাগত ঘটতে থাকা রাসায়নিক ক্রিয়ার ফলাফল। বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, মেরু অঞ্চলে ভূখণ্ডের প্রায় ১৮০০ মাইল গভীরে প্রবল উত্তাপে গলিত লোহা এবং নিকেলের অবস্থান ক্রমাগত পরিবর্তিত হচ্ছে। লোহা এবং নিকেলের অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে চৌম্বকীয় মেরুর অবস্থান নির্দেশ করা হয়। যেহেতু গলিত ধাতুসমূহ সময়ের সাথে সাথে এবং পৃথিবীর ঘূর্ণনের ফলে নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করে আসছে, তাই পরিবর্তিত হচ্ছে চৌম্বক মেরুর অবস্থানও।
বিগত ১০০ বছরের ইতিহাস অনুযায়ী দেখা যায় চৌম্বকীয় উত্তর মেরু তার অবস্থান আরও বেশি উত্তরে সরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে এর সরে আসার প্রবণতা অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি দ্রুত বলে দেখা গিয়েছে। আর দ্রুত ঘটতে থাকা এই পরিবর্তনের আনুষ্ঠানিক বিবৃতির মাধ্যমে স্বীকৃতিও দিয়েছে আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড ম্যাগনেটিক মডেল। ওয়ার্ল্ড ম্যাগনেটিক মডেল মূলত ন্যাভিগেশন, গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম এবং বৈশ্বিক যোগাযোগ রক্ষার জন্য কাজ করে থাকে।
নতুন অবস্থানে চৌম্বকীয় উত্তর মেরু গত ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে নতুন চৌম্বকীয় মেরু অবস্থান নির্ণয়ের লক্ষ্যে কাজ শুরু করে ওয়ার্ল্ড ম্যাগনেটিক মডেল। সাধারণত প্রতি পাঁচ বছর পরপর এই অবস্থান পরিবর্তনের কাজ করে হলেও এবার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় নতুন অবস্থানের সন্ধানে নেমেছে গবেষকরা। বিগত বছরে চৌম্বকীয় উত্তর মেরু রাশিয়ার দিকে প্রায় ৩৪ মাইল সরে এসেছে। অথচ মাত্র ৫০ বছর আগেও এর অবস্থান পরিবর্তন হার প্রতি বছরে মাত্র ৭ মাইল ছিল।
পৃথিবীর চৌম্বকীয় উত্তরমেরু বেশ দ্রুতই কানাডার উত্তরমেরু থেকে রাশিয়ার দিকে সরে আসছে। নতুন এই অবস্থান বিশ্বের বিভিন্ন সরকারি এজেন্সির কাজের ক্ষেত্রে বেশ উপযোগী। বিশেষ করে নাসার বাৎসরিক কার্যক্রম বা যে কোনো প্রকার মহাকাশ গবেষণায়, গ্লোবাল পজিশনিং নির্ণয়ের ক্ষেত্রে এমনকি স্মার্টফোনের স্বাভাবিক কার্যক্রমের জন্যেও নতুন এই অবস্থান বেশ গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হচ্ছে।
তবে কি উল্টে যাবে চৌম্বক মেরু?
প্রশ্নটা মোটেই অমূলক নয়। দূর ভবিষ্যতে এমন একটা দিন কি আসলেই আসবে যে দিন উত্তর মেরু সরে আসতে আসতে নিজের অবস্থানটাই পরিবর্তন করে ফেলবে? আর সে সময় আসলেই কি পৃথিবী ধ্বংসের মুখ দেখবে?
না! এমন শঙ্কায় শঙ্কিত হবার কিছুই নেই। এর আগে আরও বহুবার চৌম্বকীয় মেরুদ্বয় নিজেদের অবস্থান একেবারে উল্টেভাবে বদলে নিয়েছে। শেষবার এমন পরিস্থিতি দেখা গিয়েছে ৭৮০,০০০ বছর আগে এবং এর আগের ৮৩ মিলিয়ন বছরে আরও ১৮৩ বার এমন ঘটনার মুখোমুখি হয়েছে পৃথিবী। এমনকি এর ফলে বড় কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের নিদর্শনও পাওয়া যায়নি বলে নিশ্চিত করেছে নাসা।
তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা, আমাদের বর্তমান পৃথিবীর তথ্য প্রযুক্তি অনেকটাই এই চৌম্বক মেরুর ওপর নির্ভর করে। সে ক্ষেত্রে এখন থেকেই সাবধান হতে চেষ্টা করছেন বিজ্ঞানীরা। বরং আমাদের সৌভাগ্য, চৌম্বক মেরু পরিবর্তন হতে বেশ লম্বা একটি সময় প্রয়োজন। কোনো কারণে ৫০ বা ৬০ বছরে মেরু পরিবর্তন হলে পৃথিবীকে অন্য চোখেই দেখতে হতো।
তথ্য ও ছবি সৌজন্যে : ফোর্বস
Facebook Comments