সম্ভাব্য যুদ্ধ থেকে পিছু হটেছে ভারত-পাকিস্তান। কিন্তু পাল্টা বিমান হামলা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে তথ্যযুদ্ধ চলছে। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পুলওয়ামায় একটি আধাসামরিক বাহিনীর ওপর আত্মঘাতী হামলায় ৪৪ জওয়ান নিহত হন। স্বাধীনতা কিংবা পাকিস্তানের সঙ্গে একীভূত হতে গত ৩০ বছরের বিদ্রোহের মধ্যে এটাই ছিল সবচেয়ে প্রাণঘাতী হামলা। পাকিস্তানভিত্তিক জইশ-ই-মোহাম্মদ হামলার দায় স্বীকার করেছে। বিদ্রোহীদের পৃষ্ঠপোষকতা করায় ভারত দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানকে দায়ী করে আসছে। আর পাকিস্তান তা অস্বীকার করছে। ১৯৪৭ সাল থেকে পরমাণু শক্তিধর প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে তিনটি যুদ্ধ হয়েছে। নয়াদিল্লি ও ওয়াশিংটন বলছে, ভারতের বিরুদ্ধে ছায়াযুদ্ধে জইশ-ই-মোহাম্মদের মতো গোষ্ঠীগুলোকে ব্যবহার করছে পাকিস্তান। যদিও ইতিমধ্যে জইশ-ই-মোহাম্মদের কর্মতৎপরতার বিরুদ্ধে পাকিস্তানে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়েছে। পুলওয়ামায় আত্মঘাতী হামলার ১২ দিন পর গত ২৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখাওয়ার বালাকোট শহরের বাইরে বোমা ফেলে আসে ভারতীয় বিমান বাহিনী। ভোর হওয়ার আগেই এ বিমান হামলা চালানো হয়েছিল। এর কয়েকঘণ্টা পর ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিজয় কেশব গোখালে বলেন, জইশ-ই-মোহাম্মদের (জিইএম) সবচেয়ে বড় প্রশিক্ষণ শিবিরে জিহাদিদের লক্ষ্যবস্তু করে নিবৃত্তিমূলক হামলা চালানো হয়েছে।
গোখালে বলেন, এতে জেইএমের একটা বড় সংখ্যক বিদ্রোহী, প্রশিক্ষক, জ্যেষ্ঠ কমান্ডার ও শিক্ষানবিশ আত্মঘাতীকে হত্যা করা হয়েছে।
কিন্তু নিহতের সংখ্যা নিয়ে ভারতীয় সরকার এখন পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়নি। বিভিন্ন সূত্রের উল্লেখ করে ভারতীয় স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। তাতে সাড়ে তিনশ বিদ্রোহী নিহত হওয়ার কথা বলা হচ্ছে। ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির সভাপতি অমিত শাহসহ দলটির শীর্ষ রাজনীতিবিদরা দুইশত ৫০ বিদ্রোহী নিহত হওয়ার খবর জানিয়েছেন। নিহতের সংখ্যা নিয়ে কেউ কেউ প্রমাণ দাবি করেছেন। বিরোধী দলগুলোর অভিযোগ, নির্বাচনকে সামনে রেখে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে সংকটকে ব্যবহার করছে বিজেপি সরকার। তবে এসব কথা মাথায় নিচ্ছেন না বিজেপি। এভাবে যে যার মতো দাবি করে যাচ্ছেন। এদিকে কনিষ্ঠ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভি কে সিং অনেকটা ক্ষোভের সঙ্গে বলেছেন, বিরোধীদের মধ্যে যারা নিহতের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, আগামী অভিযানে তাদের যুদ্ধবিমানের নিচে বেঁধে বোমার মতো ফেলে দিয়ে আসা হবে। যাতে তারা লক্ষ্যবস্তু দেখার সুযোগ পান।
কেবল গাছপালা?- ভারতীয় বিমান পাকিস্তানের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে বালাকোটের কাছে বোমা ফেলে চলে গেছে বলে দেশটির আন্তঃবাহিনীর গণসংযোগ অধিদফতরের প্রধান মেজর জেনারেল আসিফ গফুর জানিয়েছেন। সেখানে কোনো ক্ষয়ক্ষতি কিংবা হতাহতের ঘটনা অস্বীকার করেছে ইসলামাবাদ। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মেহমুদ কোরাইশি বলেন, আরেকবার ভারতীয় সরকার তাদের আত্মকেন্দ্রিক, বেপরোয়া কাল্পনিক দাবির আশ্রয় নিয়েছেন।
সেখানে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের খবর শোনার কথা জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তারা বলেন, এতে একজন আহত হয়েছেন। কিন্তু কোনো অবকাঠামো ধ্বংস হয়নি। ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। কিন্তু বিভিন্ন স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সেখানে স্বউদ্যোগে পরিদর্শনে গিয়ে যে খবর দিয়েছেন, তাতে বলা হয়েছে, তারা সেখানে কোনো বিদ্রোহীদের প্রশিক্ষণ শিবিরের আলামত দেখেনি। এমনকি কোনো অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতিও তাদের চোখে পড়েনি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদকও হামলাস্থলে গিয়েছিলেন। স্থানীয়রা যেখানে হামলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন, সেখানে একটি বড় গর্ত দেখা গেছে।
এএফপির প্রতিবেদক বলছেন, সেখানে দুটি গাছের অর্ধেক কাটা অবস্থায় পড়ে আছে। এছাড়া তিনটি মাটির ঘরের একটির দেয়াল খসে পড়েছে।
আশপাশে জইশ-ই-মোহাম্মদের কোনো প্রশিক্ষণ ছিল আছে কিনা, তা স্বাধীনভাবে যাচাই করতে পারেনি এএফপি। তবে কিছু কিছু গণমাধ্যম বলছে, কাছেই একটি মাদ্রাসা আছে। তবে সেটি অক্ষত। আটলান্টিক কাউন্সিলের ডিজিটাল ফরেনসিক রিসার্চ ল্যাব জানিয়েছে, তাদের উপগ্রহে ধরা পড়া দৃশ্যপটে দেখা গেছে, বনভূমি অঞ্চলে হামলার প্রভাব পড়লেও আশপাশের অবকাঠামোতে কোনো ক্ষয়ক্ষতি চোখে পড়েনি। পাকিস্তান অনেকটা পরিহাসের ছলে বলছে, কয়েক ডজন গাছ ‘হত্যায়’ পরিবেশ সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে তারা ভারতের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করবে।
যুদ্ধবিমানের লড়াই- এরপর পরবর্তী বিতর্কের বিষয় হচ্ছে, গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ভারতীয় আকাশে পাকিস্তানি বিমানের হানা এবং দুই দেশের বিমানের আকাশযুদ্ধ। পাকিস্তান বলছে, তারা গুলি করে দুটি ভারতীয় বিমান ভূপাতিত করেছে। তার একটি নিয়ন্ত্রণ রেখার পাকিস্তানি অংশে পড়েছে, অন্যটি গিয়ে ভারতীয় অংশে ধ্বংস হয়েছে। দেশটি প্রথমে বলেছে, তারা দুই ভারতীয় পাইলটকে আটক করেছে। কিন্তু পরবর্তীতে পাক সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, তাদের কারাগারে একজন ভারতীয় পাইলট রয়েছে। পাকিস্তানের ভুল তথ্যের বিরোধিতা করে ভারতীয় এয়ার ভাইস মার্শাল আর জি কে কাপুর বলেন, ভারত একটি বিমান হারিয়েছে। সেটির পাইলটই আটক হয়েছেন। পরবর্তীতে পাকিস্তান তাকে ছেড়ে দিয়েছে। কাপুর বলেন, পাকিস্তানের একটি এফ-১৬ যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করা হয়েছে। কিন্তু ইসলামাবাদ সেই খবর অস্বীকার করেছে। তিনি বলেন, ঘটনা হচ্ছে, ভারতীয় সেনা ইউনিট পাকিস্তানি কাশ্মীরে দুটি প্যারাস্যুট পড়তে দেখেছে। এফ-১৬ বিমানে থেকে তারা নেমেছেন। ভারতীয় মিগ-২১ বিমানের গুলিতে ওই পাকিস্তানি বিমানটি ভূপাতিত হয়েছে।
-খোলা জায়গায় হামলা- পাকিস্তান বলছে, পরিষ্কার দিনের আলোতে তাদের বিমান নিয়ন্ত্রণ রেখা অতিক্রম করেছে। এরপর ছয়টি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে খোলা জায়গায় আঘাত হেনেছে। কিন্তু ভারত বলছে, পাকিস্তান তাদের সামরিক স্থাপনায় হামলা করতে চেয়েছিল। কিন্তু ভারতীয় বিমানের তাড়ায় তারা পালিয়ে গেছে। কাপুর বলেন, যদিও পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর বোমা ভারতীয় সামরিক বাহিনীর অবকাঠামোতে পড়েছে। তবে তাতে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
ছবি সৌজন্যে : ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস
Facebook Comments