অঙ্কিতা ভাণ্ডারির মৃত্যুর ঘটনায় উত্তাল শ্রীনগর। এই শ্রীনগর অঙ্কিতার নিজের শহর। উত্তরাখণ্ডে প্রাক্তন মন্ত্রীর ছেলের রিসোর্টে রিসেপশনিস্ট অঙ্কিতা ভাণ্ডারির মৃত্যু হয়েছে। যা নিয়ে টানা তৃতীয় দিন শ্রীনগরে চলল প্রতিবাদ-বিক্ষোভ। রাস্তায় নামল হাজারো মানুষ।
বিক্ষোভকারীরা শ্রীনগর জাতীয় সড়ক অবরোধ করে। বিক্ষোভকারীরা উত্তরাখণ্ড সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়। দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানানো হয়। প্রমাণ নষ্ট করতে প্রশাসন রাতারাতি বনানতারা রিসোর্টে বুলডোজার চালায় বলে অভিযোগ রয়েছে। অঙ্কিতার ভাই অজয় ভাণ্ডারির অভিযোগ, অঙ্কিতাকে নদীতে ফেলে দেওয়ার আগে মারধর করা হয়। কেবল তাই নয়, বদ্রীনাথ-ঋষিকেশেও এই ঘটনার প্রভাব দেখা যায়। অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে সেখানকার হাইওয়ে। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট অনুযায়ী, জলে ডুবে মৃত্যু হয়েছে অঙ্কিতার। ধাক্কা দেওয়ার আগে তাঁকে ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করা হয়। তাঁর শরীরেও আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছে। যদিও ময়নাতদন্ত রিপোর্টে যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণের কোনও উল্লেখ নেই।
এই রিপোর্টে অসন্তুষ্ট অঙ্কিতার পরিবার তাঁর শেষকৃত্য করতে অস্বীকার করেছে। ঋষিকেশে অঙ্কিতার বাবা বীরেন্দ্র ভাণ্ডারি এক প্রথম শ্রেণির সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “যে রিসর্টে প্রমাণ ছিল, প্রশাসন কেন বুলডোজার দিয়ে ভাঙল? এতে প্রমাণ নষ্ট করা হয়েছে।” অঙ্কিতার বাবা আরও বলেন, “বিশদ পোস্টমর্টেম রিপোর্ট প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত আমরা মেয়ের শেষকৃত্য করব না।” জেলার ডিএম বিবেক যোগদন্ডে এই বিষয়ে বলেছেন, “কে রিসোর্টে বুলডোজার চালানোর নির্দেশ দিয়েছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কেন বিস্তারিত পোস্টমর্টেম রিপোর্ট জারি করা হয়নি এবং এতে সমস্যা কী, তাও খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে। রিপোর্ট সম্ভবত সোমবার আসবে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট সরাসরি আদালতে পেশ করা হবে। নিয়ম অনুযায়ী রিপোর্ট প্রকাশ করা যাবে না।”
অঙ্কিতা ভাণ্ডারির ময়নাতদন্তের জন্য এইমস ঋষিকেশের চিকিত্সকদের একটি প্যানেল গঠন করা হয়। সূত্রের খবর, দুপুর ১২টার পর ময়নাতদন্তের প্রক্রিয়া শুরু হয়। চলে বিকাল ৩টে পর্যন্ত। চার চিকিত্সকের একটি দল ময়নাতদন্ত করেন। উল্লেখ্য, অঙ্কিতাকে খুনের অভিযোগ রয়েছে রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী বিনোদ আর্যের ছেলে পুলকিতের বিরুদ্ধে। ১৯ বছর বয়সি অঙ্কিতা তাঁর রিসোর্টের রিসেপশনিস্ট ছিলেন। ১৭ সেপ্টেম্বর রাত ৮টার দিকে তিনি পুলকিত আর্য, রিসোর্টের ম্যানেজার সৌরভ ভাস্কর এবং অঙ্কিত ওরফে পুলকিত গুপ্তের সঙ্গে ঋষিকেশে গিয়েছিলেন। পুলিশ তিনজনকেই গ্রেফতার করেছে এবং খুনের অভিযোগে অভিযুক্ত করেছে। তিনজনকেই বিচার বিভাগীয় হেফাজতে পাঠিয়েছে আদালত।
এদিকে, কালেক্টরেটের শহিদ স্মৃতিসৌধে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন এবং উত্তরাখণ্ড রাজ্য আন্দোলনকারীদের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, সোমবার বিভিন্ন সংগঠন সমাবেশের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করবে। এরপর রাজ্যপালের কাছে স্মারকলিপি পাঠানো হবে। উত্তরাখণ্ড রাজ্য নির্মাণ যোদ্ধা সংগঠন, রাষ্ট্রীয় লোক আন্দোলন ট্রাস্ট, গাইরসাইন রাজধানী নির্মাণ অভিযান এবং সম্মিলিত নাগরিক সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে এই সভার আয়োজন করা হয়। অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্ম, উত্তরাখণ্ড ইলেকশন ওয়াচ, আন্না হাজারের নেতৃত্বাধীন জাতীয় লোক আন্দোলন ট্রাস্ট, উত্তরাখণ্ড বেরোজগার সংঘ, সম্মান মঞ্চ, উত্তরাখণ্ড রাজ্য আন্দোলনকারী ইউনাইটেড সংঘর্ষ মোর্চা, উত্তরাখণ্ড প্রতিরক্ষা মহিলা মোর্চা, ভূমি আইন সংস্কার আন্দোলন সমিতি সংগঠনগুলি এতে অংশ নেয়। দুর্নীতি ও আইন-শৃঙ্খলার অবনতি নিয়ে আন্দোলন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এই সভায়। সভাপতিত্ব করেন পূর্ণা ব্যাঙ্কিং এমপ্লয়িজ অর্গানাইজেশনের নেতা চন্দন সিং নেগি এবং বর্ষীয়ান রাজ্য আন্দোলনকারী মনোজ ধিয়ানি। উপস্থিত ছিলেন ভোপাল সিং চৌধুরি, লক্ষ্মীপ্রসাদ থাপলিয়াল, ববি পানওয়ার, মনোজ বিজলওয়ান, আশা তামতা, আশা নৌটিয়াল প্রমুখ।
উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিং ধামি অঙ্কিতা হত্যা মামলার তদন্তে একটি এসআইটি গঠন করেছেন। এর ইনচার্জ ডিআইজি পি রেণুকা দেবী আজ, রবিবার জানিয়েছেন, অভিযুক্ত পুলকিত আর্যের রিসোর্টে কর্মরত সমস্ত লোককে থানায় ডাকা হয়েছে। সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। পুলকিতের রিসর্ট কীভাবে লাইসেন্সপ্রাপ্ত এবং পরিচালিত হয়েছিল, তদন্ত করছে এসআইটি। ডিআইজি জানিয়েছেন, অঙ্কিতার যে হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটগুলি সামনে এসেছে তাও খতিয়ে দেখা হবে। অঙ্কিতার কিছু হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাট ফাঁস হয়েছে ইতিমধ্যেই। সেখানে অঙ্কিতা তাঁর বন্ধুকে বলছেন, রিসোর্টে আসা ভিআইপি অতিথিদের স্পা পরিষেবা দেওয়ার জন্য তাঁকে চাপ দেওয়া হচ্ছে। জোরপূর্বক ১০ হাজার টাকা প্রলোভন দিয়ে অঙ্কিতা দেহব্যবসার কাজ করার কথা বলা হয়। তাঁকে বলা হয়, অতিথিকে খুশি করতে হবে। এটা না করলে তাঁকে কাজ থেকে সরিয়ে দেওয়ার হুমকিও দেওয়া হয়।
রিসোর্টের একজন কর্মী মনভীর সিং চৌহান বলেছেন, অঙ্কিতা ভাণ্ডারি নিখোঁজ হওয়ার আগে ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে রিসর্টের শেফকে কাঁদতে কাঁদতে ফোন করেছিলেন। চৌহান সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, “অঙ্কিতা আমাকেও ফোন করেছিল এবং তার ব্যাগ আনতে বলেছিল। তখন সে কাঁদছিল। সে আমাকে আমার ব্যাগ রাস্তায় রাখতে বলে। কিন্তু যখন একজন কর্মী ব্যাগ নিয়ে সেখানে পৌঁছয়, তখন অঙ্কিতাকে খুঁজে পাননি। অঙ্কিতাকে ১৮ সেপ্টেম্বর দুপুর ৩টেয় রিসোর্টে শেষ দেখা গিয়েছিল।”
শুক্রবার রাতে বুলডোজার চালিয়ে পুলকিতের রিসোর্ট ভেঙে দেয় প্রশাসন। শনিবার বিক্ষুব্ধ জনতা সেখানে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে স্থানীয় বিজেপি বিধায়ক রেণু বিষ্টের গাড়ির কাচ ভেঙে দেন উত্তপ্ত জনতা। এই ঘটনার পর শনিবার পুলকিতের বাবা বিনোদ আর্যকে দল থেকে বহিষ্কার করে বিজেপি। তিনি উত্তরাখণ্ড সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। বিনোদ আর্য বিজেপি ওবিসি মোর্চার জাতীয় কার্যনির্বাহী সদস্য এবং ইউপির ডেপুটি-ইনচার্জও ছিলেন। পুলকিতের ভাই অঙ্কিত আর্যকেও উত্তরাখণ্ড ওবিসি কল্যাণ কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যানের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
Facebook Comments