কলকাতার দক্ষিণে ১৯২ একর মিলিয়ে রবীন্দ্র সরোবর লেক, কলকাতার গর্ব। ফুসফুসকে আরাম দেওয়া বা একবুক তাজা নির্মল নিঃশ্বাসের প্রকৃতি পীঠস্থানের আরেক নাম দক্ষিণ কলকাতার এই লেক। বায়ুদূষণে যখন কল্লোলিনী কলকাতা ক্লান্ত, জরাজীর্ণ, এক টুকরো আকাশ ও অক্সিজেনের জন্য যখন মানুষ হাহাকার গ্রস্থ, তখন রবীন্দ্র সরোবর লেক নিশ্চয় করে মানুষের সেই স্বপ্ন পূরণের জায়গা।
১৯২০ সালে ক্যালকাটা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট বা সিআইটি এই লেকের উন্নতিকরণের পরিকল্পনা করে। এর মধ্যে ৭৩ একর জল ও বাকি এলাকায় স্টেডিয়াম, মুক্তমঞ্চ, নজরুল মঞ্চ, বুদ্ধ মন্দির, মসজিদ, ঝুলন্ত ব্রিজ, মিউজিয়াম ও লিলিপুল। শুধু প্রাতঃভ্রমণকারী নয়, অবশ্যই প্রেমিক-প্রেমীকাদের নিজস্ব ঠিকানা কলকাতার দক্ষিণের এই লেক।
রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়ামে প্রায় ২৬০০০ লোকের বসার জায়গা। বহুদিন আগে হাঙ্গেরির তাতাবানিয়া টিম এই স্টেডিয়ামে ফুটবল খেলে গেছেন। কিছুদিন আগেও অ্যাটলেটিকো-দ্য কলকাতার খেলা হয়ে গেল। আগে স্কুল কলেজের বার্ষিক ক্রীড়া অনুষ্ঠানও এখানে অনুষ্ঠিত হত। এর সংলগ্ন প্রেক্ষাগৃহে বহু অনুষ্ঠানে খ্যাতনামা শিল্পীরা গান গেয়েছেন। অথবা নাটকে অংশগ্রহণ করেছেন।
পরে সময়ের রূঢ় দৃষ্টিতে এবং সমাজ বিরোধীদের দাপটে এর জৌলুস অনেকটাই হারিয়ে যায়। রাতের দিকে এই অঞ্চল শুনশান থাকতো। মেনকা সিনেমা হলের দিকে সামান্য লোকজন চলাচল করলেও, ভেতরের দিকে ঢোকার জন্য সাহসের দরকার ছিল।
তবে ২০০২ সালে কলকাতার ঢাকুরিয়া লেক বা রবীন্দ্র সরোবর, জাতীয় লেকের তকমা পায়। লেকের সৌন্দর্যকরণে ২০ কোটি টাকা ধার্য হয়। রাজ্য সরকার স্বতঃস্ফূর্ত ১০ কোটি টাকা ধার্য করে। কলকাতা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট, ন্যাশনাল লেক কোনজার্ভেশন প্ল্যান এ বরাদ্দ টাকা খরচ করে, লেকের সৌন্দর্য রক্ষায় এবং উন্নয়নে। ঢাকুরিয়া লেক, রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে রবীন্দ্র সরোবর লেক নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।
রবীন্দ্র সরোবর জাতীয় লেকের বুদ্ধ মন্দির নিপ্পনজান ম্যোয়োহোজি অন্যতম সেরা আকর্ষণ। এর সঙ্গে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড বুদ্ধিষ্ট অ্যাসসিয়েশনের প্রবক্তা নিচিদাতসু ফুজির নাম নিশ্চয় করে উল্লেখযোগ্য। যুগল সিংহ বিশ্বাস ও শান্তির প্রতীক, যাকে জাপানীরা কোমাইনু বলে।
ঝুলন্ত ব্রিজের কথা না বললে লেকের বর্ণনা অসমাপ্ত থেকে যায়। ১৯২৬ সালে তৈরি এবং ১৯৬২ সালে সংস্কারের পর এটি একটি উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান। এর নিচে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের স্বাধীন বিচরণ সত্যি খুব মনোহরক। এর সংলগ্ন মসজিদও উল্লেখযোগ্য।
লেকের ‘কামান’ সম্ভবত প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২০ সালে। বলা হয়, এই কামানটি সিরাজদৌল্লা’র দ্বারা ব্যবহৃত।
লেকের ছোট চিড়িয়াখানায় অবশ্য রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সস্বমহিমায় নেই। তবে শীতকালে বহু পাখি এখানে উড়ে আসে।
টালিগঞ্জের দিকের লেকে ১৯৮৫ সালে ট্রয়ট্রেন চালু হয়। স্টেশনের নাম ছিল ‘স্বপ্নপুরী’। আগে ওখানে বাধানো জলাশয় ছিল। দোলনা, স্লিপ সবই ছিল। কিন্তু ট্রয়ট্রেন যে কেনো হঠাৎ ১৯৮৯এ বন্ধ হয়ে গেল, সবার মনে একই প্রশ্ন ঘুরেফিরে আসে।
গোলপার্কের দিকে নজরুল মঞ্চে বহু অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। আগে চতুর্দিক খোলা থাকলেও এখন এই বাতানুকূল করা হয়েছে। ‘ডোভার লেন মিউজিক কনফারেন্স ২০১৭’ এখানে অনুষ্ঠিত হয়।
রবীন্দ্র সরোবর লেকের ১৮৫৮ সালে ব্রিটিশদের ক্যালকাটা রোয়িং ক্লাব ১৯০১ সালে অ্যান্ডারসন রোয়িং ক্লাব নামে পরিচিতি পায়। যাকে ‘ARAE’ বলা হয়। এছাড়া বেঙ্গল রোয়িং ক্লাব, লেক ক্লাব, ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি রোয়িং ক্লাব, ইন্ডিয়ান লাইভ সেভিং সোসাইটির পরিচিতি সর্বজনে বঞ্চিত।
অ্যান্ডারসন সুইমিং ক্লাবে ‘ওয়াটার ব্যালে’ দর্শনীয় ও প্রশংসার দাবি রাখে। রবীন্দ্র সরোবর লেকে বহু অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়েছে আগেই বলেছি। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘কিশোর কুমার নাইট’ ও শচীন দেব বর্মণের অনুষ্ঠান।
এই লেক আবার স্বমহিমায় বিরাজমান। সন্ধ্যাবেলায় মিউজিক্যাল ফাউন্টেন, মুক্তমঞ্চের অনুষ্ঠান অথবা বাধানো চাতাল, হাঁটার রাস্তা পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় তো বটেই, প্রাতঃভ্রমণকারীদের কাছেও স্বর্গীয় উদ্যান। লাফিং ক্লাব, যোগব্যায়ামের ক্লাব, ফুটবল-ক্রিকেট কোচিং ক্লাব, সব নিয়েই রবীন্দ্র সরোবর লেক। আগে লেকের জলে ‘প্যাডেল বোটিং’ অন্যতম আকর্ষণ ছিল। কাশ্মীরের ডাল লেককে মনে করিয়ে দিত।
তবে কলকাতায় সব কিছুই বড় ক্ষণস্থায়ী। প্রশাসনের নিজস্ব প্রচেষ্টায় এখানে ‘দুর্গা ঠাকুরের মিউজিয়াম’ তৈরি হয়েছে, বড় বড় ক্লাব গুলোর উল্লেখযোগ্য মূর্তি এখানে রাখা হয়েছে দর্শনার্থীদের জন্য।
লেকের অন্যতম দর্শনীয় ব্যক্তি হলেন পরিতোষ সূত্রধর । যিনি একজন চা বিক্রেতা। কাউ বয় সুলভ হাবভাব এবং সাজসজ্জা, যা মানুষের কাছে অন্যতম বিনোদন।
লেকের একদিকে রামকৃষ্ণ মিশন ইন্সটিটিউট অব কালচার। একদিকে লেক গার্ডেন্স। একদিকে টালিগঞ্জ ও অন্যদিকে সাউদার্ন অ্যাভিনিউ ও লেক কালীবাড়ি। গোলপার্কের দিকে বাচ্চাদের সাফারি পার্ক। কচিকাঁচাদের মুক্তাঙ্গন।
কলকাতার সব অঞ্চল যখন, বহুতল অট্টালিকার গ্রাসে, তখন এই মুক্তাঞ্চল এখনও মানুষের কাছে ভগবানের আশীর্বাদ।
নিজস্ব চিত্র
Facebook Comments