পিছিয়ে পড়া মানুষের স্বপ্ন ভূমি নামে পরিচিত আল-আমীন মিশনে অনুষ্ঠিত হলো পুনর্মিলন উৎসব। অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে তেমনি দেশে শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে এ জেলার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে ক্ষুদিরাম বসু, মাতঙ্গিনী হাজরা, সতীশ চন্দ্র সামন্ত, সুশীল ধাড়া, প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্যরা যেমন এ জেলাকে গর্বিত করেছেন তেমনি প্রাতঃস্মরণীয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, শিক্ষাব্রতী রাজনারায়ণ বসুরা শিক্ষাক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। আবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম উপাচার্য হাসান সোহরাওয়ার্দীর জন্ম এই মেদিনীপুর শহরে। এহেন ইতিহাস বিজড়িত মেদিনীপুর শহরের উপকণ্ঠে এলাহীগঞ্জে আল আমীন মিশন ক্যাম্পাসে গত ২০ এবং ২১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হলো আল আমীন মিশনের পুনর্মিলন উৎসব। মিশনের প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্র ছাত্রী, অভিভাবক, উৎসাহী এলাকাবাসী, শিক্ষক, শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী ও সরকারী প্রশাসকদের উজ্জ্বল উপস্থিতিতে এই পুনর্মিলন উৎসব একটি চাঁদের হাটে পরিণত হয়।
মিশনের ঐতিহ্য অনুযায়ী কুরআন পাঠ ও তার বাংলা তর্জমা দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। কুরআন পাঠ করেন মিশনের দুই ছাত্র ইয়াদুল ইসলাম ও রাহিবুর রহমান। এরপর প্রারম্ভিক স্বাগত ভাষণে মিশনের প্রাণপুরুষ তথা সাধারণ সম্পাদক এম নুরুল ইসলামের অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি গোটা অনুষ্ঠানের সুর বেঁধে দেয়। তিনি বলেন, এটি একটি ঘরোয়া অনুষ্ঠান এবং নতুন ও পুরাতনের মিলনের অনুষ্ঠান, এখানে আমাদের ভূমিকা অভিভাবক তথা বাগানের পরিচর্চায় যুক্ত মালিদের মতো। উপস্থিত শিক্ষাব্রতী ও শিক্ষানুরাগীদের সামনে মিশনের সূচনার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, মৌলানা আজাদ কলেজে পড়ার সময় তিনি তাঁর প্রিয় এক অধ্যাপকের কাছ থেকে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের জীবনী ও জীবন দর্শন বিস্তারিত শোনেন। পরবর্তীকালে তিনি রামকৃষ্ণ মিশনের কর্মকাণ্ডে বিশেষ ভাবে অণুপ্রাণিত হন। এভাবেই তিনি তাঁর স্বসম্প্রদায়ের উন্নয়নে আত্মনিয়োগের রসদ খুঁজে পান। তাঁরও ইচ্ছা হয় আধুনিক ও মুল্যবোধের সম্মিলিত শিক্ষা আয়োজনের। আর সে থেকেই হাওড়ার খলতপুরে প্রতিষ্ঠা করেন আল আমীন মিশনের। তিনি তাঁর কাজের আরো অণুপ্রেরণা পান কুরআন মজীদের সেই অমোঘ বাণী থেকে, যেখানে নিজ সম্প্রদায়ের উন্নয়নে সচেষ্ট হওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। এই কাজে তিনি পাশে পেয়ে যান মানবকল্যাণকামী কিছু উৎসাহী সঙ্গী-সাথীকে।
মেদিনীপুরে আল আমীন মিশনের শাখা প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ২০০৭ সালে ভাড়া বাড়িতে মাত্র ৪৪ জন ছাত্র নিয়ে শুরু হয় মেদিনীপুর শাখা। এই শাখা সুচারুভাবে পরিচালনার ক্ষেত্রে মহম্মদ ইস্রাফিল ও তাঁর দুই সহযোগী ফরিজুদ্দিন ও ইসমাইলের কথা উঠে আসে নরুল ইসলামের বক্তব্যে। পরে আল আমীন মিশনকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে দুই শিক্ষাব্রতী সেখা সেলিম ও সেখ আব্দুল মালেক এবং এলাহিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক ও পরিচালন সমিতির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তিনি আরও বলেন বাংলার নবজাগরণের প্রাণপুরুষ রাজা রামমোহন রায় থেকে শুরু করে বিদ্যাসাগর, রামকৃষ্ণ , বিবেকানন্দসহ বাংলা তথা দেশের বিভিন্ন মনীষীদের মানব কল্যানের আদর্শকে সামনে রেখে এগিয়ে চলেছে আলা আমীন মিশন। তিনি বলেন, হাওড়ার খলতপুর থেকে পিছিয়ে পড়া সংখ্যালঘু সমাজে আলোকায়ানের যে কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছিল তা আজ গোটা পশ্চিমবঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা যারা ভালো আছি তাদেরকে সেই ভালোর কিছুটা ত্যাগ করে, পিছিয়ে থাকাদের টেনে তুলতে হবে, না হলে আমাদের ভাল থাকার কোন মানে হয় না। নুরুল ইসলাম আরো জানান তিনি তার কাজে শুরু থেকে আজ পর্যন্ত সংখ্যা গরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের অসংখ্য মানুষের সাহায্য সহযোগিতা তিনি পেয়েছেন এবং সে জন্য তিনি তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের নানা সহযোগিতার কথাও তিনি উল্লেখ করেন। তিনি উপস্থিত সকলের কাছে একথাও জানান, মিশনের ডে স্কুল, স্টাডি সার্কেলে মেডিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিং, ডব্লুবিসিএস এর কোচিংয়ের ভর্তি এবং সম্প্রতি চালু হওয়া নামমাত্র মূল্যে মিশনের প্রাক্তনী বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের কাছ থেকে চিকিৎসা পরিষেবা প্রভৃতিতে অখন্ড বাঙালি সমাজের সবাই উপকৃত হচ্ছেন। সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, নিজেদের উদ্যোগে শিক্ষার আলো চারিদিকে ছড়িয়ে দিতে হবে যাতে করে সংখ্যালঘু সমাজের ছেলেমেয়েরাও দেশের যোগ্য নাগরিক হয়ে ওঠে দেশ- রাজ্য তথা সমাজের উন্নয়নে কার্যকরী ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত খড়গপুর আইআইটির প্রাক্তন অধ্যাপক বিশিষ্ট বিজ্ঞানী সুকুমার মাইতি বলেন, সমাজে পরিব্যাপ্ত অনেক গোলমাল, দুঃখ-যন্ত্রণার মাঝে মাঝে ব্যতিক্রমী কয়েকজন এগুলো দূরীকরণে এগিয়ে আসেন সেরকমই একজন জনাব এম নুরুল ইসলাম। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার এডিএম (এল আর) উত্তম অধিকারী বলেন, জনাব এম নুরুল ইসলামের আলোচনায় যা সব শুনলাম, সেসবই মূল্যবোধ ভিত্তিক শিক্ষার ফল এবং সমাজে মূল্যবোধ ভিত্তিক শিক্ষার আজ চরম প্রয়োজন। মেদিনীপুর কলেজের (অটোনমাস) প্রিন্সিপাল গোপাল চন্দ্র বেরার মতে, আল আমীন মিশন হল বিদ্যালয় প্লাস, যেখানে মানুষ গড়ার সহায়তা করা হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. এস এ এইচ মঈনুদ্দিন মেদিনীপুর কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক সুভাষ সামন্ত, পাঁচখুরি দেশবন্ধু হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক তারাশঙ্কর মহাপাত্র, এলাহিয়া হাই মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক তোজাম্মেল হোসেন, আল আমিন মিশন স্টাডি সার্কেলের দিলদার হোসেন, মহম্মদ মহসীন আলী, বিধায়ক দীনেন রায়, খড়গপুর আইআইটির অধ্যাপক ড.প্রণব কুমার দত্ত, মেদিনীপুর ল কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ মুকুল রায়, কেডি কলেজ অফ কমার্স এর অধ্যক্ষ দুলাল চন্দ্র দাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্যাক্স কমিশনার আখতারুল আমিন, বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও মেডিকেল অফিসার বিমল গুড়িয়া, প্রাক্তন শিক্ষক ও বিশিষ্ট লেখক অশোক পাল আলোচনায় অংশগ্রহণ করে আল আমীন মিশনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন। দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ ২১ অক্টোবর পূর্ব বর্ধমানের কালনার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর জাহাঙ্গীর মল্লিক তাঁর অভিজ্ঞতার কথা উপস্থিত প্রাক্তনী ও বর্তমান ছাত্রছাত্রীদের সামনে তুলে ধরেন। দু’দিনের অনুষ্ঠানে এক দিকে চলে খুদে বিজ্ঞানী ছাত্রছাত্রীদের তৈরি নানান মডেল নিয়ে বিজ্ঞান প্রদর্শনী। অন্যদিকে ছিল বিনামূল্যে চিকিৎসা পরিষেবার মেডিকেল ক্যাম্প। ছাত্র-ছাত্রীদের বসে আঁকো প্রতিযোগিতা, কুইজ, সঙ্গীত, কবিতা আবৃত্তি, স্বরচিত কবিতা পাঠ ছিল অনুষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। কুইজের আসর মাতাতে সুদূর ২৪ পরগনা থেকে এসেছিলেন বিখ্যাত কুইজ মাস্টার ইখতিয়ার উমর আহমেদ। পুনর্মিলন স্মারক পত্রিকা “সেদিন” অনুষ্ঠান মঞ্চে প্রকাশিত হয়। এটি সম্পাদনা করেছেন সিঙ্গাপুরের নানিয়াং টেকনোলজিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত তথা এই শাখার তৃতীয় ব্যাচের ছাত্র রোসাদেয় আলী লস্কর। অনুষ্ঠানে এই শাখার কৃতী প্রাক্তনীদের পুরস্কৃত করা হয়। প্রায় ৪০০ প্রাক্তনী এই পুনর্মিলন উৎসবে যোগ দেন। অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পেরে গর্বিত রাজবুল আলী খাঁন, আসাদুল আলী খাঁন, সাজাহান আলী, মনোজ খাঁনসহ সমস্ত প্রাক্তনীরা। উল্লেখ্য তিন দশকের আল আমীন মিশনের বর্তমানে ৭০ টি আবাসিক শাখায় প্রায় ১৪ হাজার ছাত্রছাত্রী অধ্যয়নরত।
ছবি সৌজন্যেঃ আল আমীন মিশন
Facebook Comments