ভূগোল ও পরিবেশ পত্রিকা গোষ্ঠী ও পূর্বাশা ইকো হেল্পলাইন সংস্থার আয়োজনে কলকাতার সাউথ ক্যালকাটা গার্লস কলেজের ভূগোল বিভাগের সহযোগিতায় কলেজের সেমিনার হলে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল একটি এক দিবসীয় সুন্দরবন বিষয়ক রাজ্যস্তরীয় আলোচনাসভা। বুধবারের এই অনুষ্ঠানে কলেজের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় অধ্যক্ষা ড. অপর্ণা দে ও ভূগোল বিভাগের শিক্ষক শিক্ষিকা ও ছাত্রীবৃন্দসহ আহ্বায়ক অধ্যাপিকা সুস্মিতা মণ্ডল। উক্ত আলোচনা সভার প্রধান বক্তা হিসাবে উপস্থিত ছিলেন পরিবেশবিদ তথা রায়দিঘি কলেজের ভূগোলের অধ্যাপক সনৎকুমার পুরকাইত। তাঁর বক্তব্যের বিষয় ছিল “ভারতীয় সুন্দরবনের প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা- একটি ভূপরিবেশগত দৃষ্টিভঙ্গি” যা বর্তমান প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীদের কাছে সুন্দরবনের পরিবেশ নিয়ে বিজ্ঞানসম্মত এক নতুন চেতনা তুলে ধরে। সাথে সাথে তিনি তাঁর সুন্দর উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে বর্তমান কিশোর ছাত্রীসমাজের কাছে ভূগোল ও পরিবেশ মানবসভ্যতার বিকাশে কি কি ভূমিকা পালন করে তা ব্যাখ্যা করেন। বিশিষ্ট বক্তা হিসাবে উপস্থিত ছিলেন ভূগোল ও পরিবেশ পত্রিকার সম্পাদক তথা শিক্ষক উমাশঙ্কর মণ্ডল মহাশয়। তিনি সুন্দরবনের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন অডিওভিজুয়াল বক্তৃতার মাধ্যমে।
প্রতি দিন জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তৈরি হওয়া বিপদ গ্রাস করছে সুন্দরবনকে। এই অঞ্চলে নদীর জলস্তর বাড়ছে বছরে গড়ে ৮ মিলিমিটার। দুনিয়ার যে দ্বীপরাষ্ট্রগুলিকে ‘সর্বাধিক বিপন্ন’ তকমা দিয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জের ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ, সেখানে জলস্তর বৃদ্ধির হার বছরে পাঁচ মিলিমিটারের কাছাকাছি। অঞ্চলের ৫০ শতাংশ মানুষ বাস করেন দারিদ্রসীমার নীচে। সিংহভাগ শিশু অপুষ্টির শিকার।
৭০ শতাংশ বাড়িতে এখনও পরিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা নেই, মাত্র ১৭ শতাংশ বাড়িতে বিদ্যুৎ পৌঁছেছে। পরিবেশ সংক্রান্ত কারণে প্রতি বছর প্রায় চার হাজার মানুষ অকালে মারা যান, অসুস্থ হন প্রায় কুড়ি লক্ষ মানুষ। মহিলা আর শিশুরাই বেশি অসুস্থ থাকেন।ঐতিহ্যবাহী জঙ্গলে আছে পরিবার নিয়ে মানুষের বসবাস। তারা মধু সংগ্রহ করে, কাঠ কেটে, মাছ ধরে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে চলে। এসব জীবিকা নির্বাহ করে থাকার সময় এসব মানুষদের কত যে বিপদের সম্মুখীন হতে হয় তার ইয়ত্তা নেই। মধু সংগ্রহ বা কাঠ কাটতে যাওয়ার সময় বাঘে নিয়ে যাওয়ার ভয়, সাপ কামড়ানোর ভয়, নদীতে মাছ ধরতে যাওয়ার পর কুমিরের ভয় ইত্যাদি সর্বদা তাদের চিন্তার কারণ।
তবুও মানুষ থাকে সেখানে।কোমর জলে জাল টানতে টানতে দিন-রাত কেটে যায়। নোনা জলে অবশ হয়ে আসে শরীর। ছাড়লে চলবে না, ওটাই যে অন্ন জোগায়। হিঙ্গলগঞ্জের কালীতলা গ্রামে এমন অসংখ্য পরিবারের খোঁজ মিলল যাদের উপার্জনের একমাত্র উপায় চিংড়ির মীন। দিনের আলো ফোটার আগে ছোট ছোট খাড়িতে মীন ধরতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন গ্রামের মহিলারা।শুধু রায়মঙ্গল নয়, সন্দেশখালির বড়কলাগাছি, ছোট কলাগাছি, বেতনি, ঘটিহারা, ডাসা, রামপুর, হিঙ্গলগঞ্জের সাহেবখালি, গৌড়েশ্বর, কালিন্দী, হাড়োয়া-মিনাখাঁর বিদ্যাধরী নদীতে প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষ, বিশেষত মহিলারা মীন ধরতে নেমে পড়েন৷ এই ছবি রোজকার৷ দিন-রাত বলে আলাদা কিছু নেই৷ জোয়ার থেকে যখন নদীতে ভাটা লাগে, মীন ধরতে নেমে পড়েন দল বেঁধে। সঙ্গে বাঁশের চটার ফ্রেমে ঘন মশারির নেট লাগানো টানা জাল আর একটা অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি। ভাটা শুরু থেকে সার ভাটা পর্যন্ত ৩ ঘণ্টা টানা জলে থেকে মীন সংগ্রহ৷ জোয়ার এলে উঠে পড়া৷ আবার ভাটা শুরু হলে নদীতে নামা৷ জোয়ার-ভাটার ওপর নির্ভর করে নদীতে ওঠা-নামা৷ মীন সংগ্রহের পর পাড়ে উঠে বাছাই। এভাবেই চলে রোজনামচা। ‘দিনে ১৫০ থেকে ২০০ মীন ধরি৷ কোনও কোনও দিন তারও কম হয়ে থাকে৷ কপাল ভালো থাকলে এক এক দিন আবার ২৫০ থেকে ৩০০ মীনও পাওয়া যায়। ৩০ থেকে ৫০ পয়সায় একেকটা বাগদার মীন বিক্রি হয়৷ তবে বিক্রি করার কোনও জায়গা নেই৷ ব্যাপারীরা হাঁড়ি নিয়ে এসে যা দাম বলে, তাতেই দিয়ে দিতে হয় কষ্টের সংগ্রহ৷ ব্যাপারীদের হাত ঘুরে ডবল দামে বাগদার বাচ্চা চলে যাচ্ছে মেছোঘেরিতে’।
গরিবের পেট রাখি না প্রকৃতির ভারসাম্য রাখি, এই দুইয়ের মাঝে পড়ে ভোগান্তি সেই পরিবারগুলির, মীন বেচে যাদের দিন চলে। দীর্ঘ সময় জলে থাকার ফলে শরীরে নানা রোগ বাসা বাঁধে, ওদের ভাষায় যা নোনা ধরা। এত কষ্ট করে মীন ধরেও লাভের গুড় খায় ব্যাপারীরা। সঠিক দাম পাওয়ার ব্যবস্থা, মৎস্যজীবীদের চিকিৎসা, আরেকটু সরকারি নজরদারি থাকলে যথেচ্ছ মীন ধরার প্রবণতা অনেকটাই কমে যেত। অথচ এই চিংড়ি বিদেশে রফতানি করে কোটি কোটি ডলার রোজগার হয় দেশের। কাহিনীর পেছনের সেই কারিগর, হাজারো মৎস্যজীবীরা। সম্পাদক উমাশঙ্কর মণ্ডল স্বাগত ভাষণে বলেন সারা রাজ্য জুড়ে আমাদের এই কর্মকাণ্ড একেবারে বুনিয়াদি বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ চলছে। উপস্থিত ছিল বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের দুই শতাধিক ছাত্রছাত্রী। সমগ্র অনুষ্ঠানের জন্য ভূগোল ও পরিবেশ এর টিমকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন উপস্থিত শিক্ষাব্রতী মানুষ। শ্রী মণ্ডল আরও বলেন আগামী দিনে এই ধরনের আলোচনাচক্র বেশী করে যাতে আয়োজন করা যায় তিনি চেষ্টা করবেন। আলোচনাসভার সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য প্রলয় হালদার। আলোচনার শুরুতেই ভূগোল ও পরিবেশ পত্রিকার আগামী ‘সুন্দরবন’ শীর্ষক সংখ্যা নিয়ে আলোচনা হয়। ছাত্রছাত্রীদের পাশাপাশি একদল তরুন গবেষক ও শিক্ষকেরা উপস্থিত থেকে এই অনুষ্ঠান সাফল্য মণ্ডিত করতে যথাযথ ভূমিকা পালন করেন।
ছবি সৌজন্যঃ উমা শঙ্কর মণ্ডল
Facebook Comments