আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিভিন্ন কাজে দীর্ঘদিন ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পড়ুয়ারা। সেই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন আনিস খান। পরিবারের অভিযোগ, পুলিশের পোশাক পরা লোকেরা তিন তলা থেকে ফেলে আনিসকে হত্যা করেছে। হাওড়া জেলার আমতার বাসিন্দা আনিস খান। পরিবারের দাবি, ২৮ বছর বয়সি তরুণকে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হচ্ছিল।
তবে স্থানীয় পুলিশকে জানালেও এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এনআরসি-সহ (জাতীয় নাগরিকপঞ্জি) একাধিক আন্দোলনে প্রতিবাদের মুখ ছিলেন আনিস। নিজের এলাকার জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের নেতৃত্বও দিয়েছেন। শুক্রবার এক জলসা থেকে বাড়ি ফেরার কিছুক্ষণের মধ্যেই চার ব্যক্তি আসে তার খোঁজে।
একজনের পরনে ছিল পুলিশের পোশাক, অন্যরা ছিলেন সিভিক পুলিশের পোশাকে। এমনটাই দাবি আনিসের পরিবারের। বারবার গেট খোলার অনুরোধ করলে আনিসের বাবা এক সময় খুলে দেন গেট। চারজনের তিনজন দ্রুত চলে যান তিন তলায়।
আনিস তখন বারান্দায় বসে কানে হেডফোন লাগিয়ে মোবাইল ফোনে কিছু একটা শুনছিলেন। পরিবারের দাবি, রাত তিনটার দিকে ওই দুই ব্যক্তি তিন তলায় উঠে আনিসের মাথায় প্রথমে আঘাত করে, তারপর তিনতলা থেকে ফেলে দেয়। পরে পরিবারের পক্ষে থেকে সংবাদমাধ্যমকে আরো জানানো হয়, বারবার ফোন করা সত্ত্বেও আমতা থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে যায় ছয় ঘণ্টা পরে। ময়না তদন্ত পরিবারের সবার অনুপস্থিতিতে করানোর অভিযোগও উঠেছে।
আনিসের মৃত্যুকে ঘিরে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে পশ্চিমবঙ্গে । আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়-সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পড়ুয়ারা বিক্ষোভ শুরু করেন। পরিবারের দাবি, পুলিশের ভূমিকা আনিসের পরিবারের অভিযোগ, শুক্রবার রাতে পুলিশের পোশাক পরে চার জন ব্যক্তি তাদের বাড়িতে আসেন। তাদের তিন জন সিভিক ভলান্টিয়ার ও এক জন খাকি পোশাকে ছিলেন।
খাকি পোশাক পরা ব্যক্তি নিজেকে আমতা থানার অফিসার পরিচয় দিয়ে আনিসের বাবাকে আটকে রাখেন। বাকিরা দ্রুত চলে যান তিনতলায়। একটু পরে ছাদ থেকে কিছু একটা পড়ার শব্দ পান পরিবারের লোকেরা। তারপরই সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে ওই পুলিশের পোশাক পরা ব্যক্তিকে বাকি তিন জন বলেন, ‘‘স্যর কাজ হয়ে গিয়েছে।” এরপর রক্তাক্ত আনিসকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও পথেই মৃত্যু হয় তার।
আনিসের বাবা সালেম খানের অভিযোগ, পুলিশই তাঁর ছেলেকে বাড়ির তিনতলার ছাদ থেকে ফেলে হত্যা করেছে। ছেলে খুন হওয়ার পরে তিনি আমতা থানায় ফোন করে পুলিশকে ডাকলেও তারা আসেনি। তার দাবি, শনিবার ভোরে বারবার ফোন করলেও পুলিশ আসে সকাল নয়টায়। আনিসকে ছাদ থেকে ঠেলে ফেলে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে পুলিশ ও সিভিক ভলান্টিয়ারের বিরুদ্ধে।
তবে পুলিশ দাবি করছে, শুক্রবার রাতে তাদের কেউ আনিসের বাড়িতে যাননি। ময়নাতদন্তের রিপোর্টে আনিসের মাথায় ক্ষতচিহ্ন দেখা গিয়েছে। বাড়ির লোকের দাবি, তারা থানায় পৌঁছানোর আগে ময়নাতদন্তের জন্য দেহ নিয়ে হাওড়ার উলুবেড়িয়া মহকুমা হাসপাতালে যায় পুলিশ। আনিসের বাড়ি থেকে ৮০ মিটার দূরে একটি সিসিটিভি ক্যামেরা রয়েছে।
সোমবার সকাল পর্যন্ত সেখান থেকে কোনো ছবি নেওয়া হয়নি বলে জানা গিয়েছে। ময়নাতদন্ত নিয়ে আনিসের পরিবার প্রশ্ন তুললেও পুলিশ ও ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আনিসের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষদর্শীরা রয়েছেন। তদন্তে সেই সব প্রত্যক্ষদর্শী ও সাক্ষ্য অন্যতম সহায়ক হতে পারে। আনিসের লেখা একটি চিঠি ‘ভাইরাল’ হয় সোশ্যাল মিডিয়ায়।
যদিও এই চিঠির সত্যতা যাচাই করেনি ডয়চে ভেলে। সেখানে লেখা রয়েছে, এলাকায় একটি রক্তদান শিবির আয়োজনের চেষ্টা করায় স্থানীয় তৃণমূল নেতারা আপত্তি জানান। কারণ আনিস তৃণমূল-বিরোধী রাজনীতি করেন। বিচারের দাবিতে তুমুল বিক্ষোভ ও মমতার আশ্বাস রবিবার আনিসের বাড়িতে যান কৌশিক সেন, বোলান গঙ্গোপাধ্যায়-সহ নাগরিক সমাজের কয়েকজন প্রতিনিধি।
এদিকে আনিস হত্যার মামলাটি জরুরিভিত্তিতে গ্রহণ করেছে আদালত। মঙ্গলবার এ বিষয়ে সব তথ্য জমা দিতে আবেদনকারী পক্ষকে নির্দেশ দিয়েছে বিচারপতি রাজাশেখর মান্থার বেঞ্চ। আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারি কলকাতা হাই কোর্টে ওই আবেদনের শুনানি হবে। নবান্নে আনিসের পরিবারকে দেখা করতে ডেকেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দেখা করতে যাবেন আনিসের বাবা। সোমবার আনিসের বাড়িতে যান ডিএসপি সুব্রত ভৌমিক। আমতা থানার ওসি দেবব্রত চক্রবর্তীকে সঙ্গে নিয়ে ঘটনাস্থল ঘুরে দেখেন তিনি। এদিন আমতায় আনিসের বাড়িতে গিয়ে বিক্ষোভের মুখে পড়েন পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েতমন্ত্রী পুলক রায়।
অন্যদিকে সোমবার কলকাতার কলেজ স্ট্রিটে ভারতীয় ছাত্র ফেডারেশনের তরফে আনিসের মৃত্যুর প্রতিবাদে অবরোধ চলে দীর্ঘক্ষণ। আনিস হত্যার প্রতিবাদে কলেজ স্ট্রিটে বিক্ষোভ দেখায় এআইডিএসও সংগঠনও। বাম ছাত্র রাজনীতির অতি পরিচিত মুখ দীপ্সিতা ধরের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল আনিসের। পরবর্তী সময়ে অবশ্য আইএসএফ-এর সঙ্গে যুক্ত হন তিনি।
গণ আন্দোলনের কর্মীদের গ্রেপ্তারি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় আনিস তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। পুলিশের কাছে নিরাপত্তা চেয়েও পাননি তিনি। মৃত্যুর পর বাড়িতে মোতায়েন করা হয়েছে পুলিশ। সোমবার এক সাংবাদিক বৈঠকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ছাত্রনেতা আনিস খানের রহস্যমৃত্যুর তদন্ত করবে বিশেষ দল।
১৫ দিনের মধ্যে ওই তদন্তকারী দল রিপোর্ট জমা দেবে। মমতার কথায়, ‘‘আনিসের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ভাল ছিল। আনিস আমাদের হেল্পও করেছিলেন। আনিসের পরিবারকে বিশ্বাস রাখতে বলবো।
নিরপেক্ষ তদন্ত হবে- কথা দিলাম। দোষীর কোনো ক্ষমা নেই।” আনিসকে নিজেদের সংগঠনের সদস্য বলে দাবি করছে একাধিক রাজনৈতিক দল। আনিসকে তাদের দলের ছাত্র সংগঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা বলে দাবি করেন ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্টের একমাত্র বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকি। কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠন ছাত্র পরিষদ দাবি করেছে আনিস ছিলেন তাদের সংগঠনের সদস্য।
সিপিএমের ছাত্র সংগঠন এসএফআইয়ের দাবি, আনিস ছিলেন তাদের সক্রিয় সদস্য। বিধানসভা নির্বাচনে সংযুক্ত মোর্চার নেতৃত্বে ব্রিগেড সমাবেশে দেখা গিয়েছিল আসিফকে। পাশাপাশি পুলিশের বয়ানে উঠে এসেছে অন্য একটি দিকও। ছাত্রনেতা আনিস খানের বিরুদ্ধে পকসো আইন (প্রোটেকশন অব চিলড্রেন ফ্রম সেক্সুয়াল অফেন্সেস অ্যাক্ট)-এ মামলা দায়ের হয়েছিল।
আদালত থেকে সমন জারি হয়। যৌন নিগ্রহ থেকে শিশুদের বাঁচাতে পকসো আইন চালু হয়েছিল ভারতে। সোমবার এমনই তথ্য দেন হাওড়ার পুলিশ সুপার (গ্রামীণ) সৌম্য রায়। আরকেসি/এসিবি (আনন্দবাজার পত্রিকা, এবিপি আনন্দ, হিন্দুস্তান টাইমস)
Facebook Comments