লাশ!!!! প্রথমেই এমন একটা নেতিবাচক শব্দ দিয়ে প্রতিবেদন শুরু করার জন্য আমি What’s New Life এর প্রতিবেদক রৈনাক দত্ত আপনাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
আপনারা এতক্ষনে ছবিটা নিশ্চয় দেখে ভাবছেন এই ছবির সাথের লেখাতে লাশ আসছে কিভাবে। আমি বুঝিয়ে বলছি, সঙ্গে থাকুন।
রোজকারের মত অফিস আসার জন্য অন্য ট্রেন থেকে নেমে শিয়ালদহ সাউথ সেকশানের দিকে হাঁটছি। কানে হেডফোনে গান চলছে, মাথা তুলে ডিসপ্লে বোর্ডে দেখলাম ডায়মন্ড হারবার লোকালটা ছাড়তে এখনো পাঁচ মিনিট বাকি। আমি সময় নিয়ে গত রবিবারের কভার করা অনুষ্ঠানের স্টোরিটার কথা ভাবতে ভাবতে ট্রেনের কাছাকাছি চলে আসলাম। হটাৎ ট্রেনের বাফারে বসা দুজনের দিকে চোখটা পড়ল। ফটো-জার্নালিস্ট তো তাই মস্তিষ্কের স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে পা দুটো দাঁড়িয়ে গেলো। দেখলাম গার্ডের ঘরে কেউ নেই, আর বাকি যাত্রীরা কোনো নজর করছে না আলাদা করে। আমি ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বাইরে আনার চেষ্টা করলাম না, কারণ আমি ওদের সজাগ করতে চাইনি। খুব দ্রুত মোবাইলে দুটো ক্লিক করে ট্রেনে উঠে পড়লাম।
এক ঝলকে ছবিটা দেখে মজার মনে হল এবং সেইরকমই কিছু স্টোরি ভাবতে ভাবতে অফিস চলে আসলাম। কিন্তু মনে একটা খুঁতখুঁতানি রইল যে সাধারণত ওই রকম বাফারে বাঁশ ঝুলিয়ে জেলেরা মাছ বিক্রি করে ফেরার পথে বড় বড় ফাঁকা হাঁড়ি বেঁধে দিয়ে ভেন্ডারে উঠে পড়ে, কিন্তু বসেনা কেউ ওখানে। তাই তখনকার মত ছবিটা মাথা থেকে সরিয়ে দিলাম যে ফেরার পথে ডেইলি প্যাসেঞ্জারদের থেকে নিশ্চিত হব।
“আরে এরা তো ডোম, লাশ নিয়ে যাচ্ছে। তার আগে কাটা পড়েছে নিশ্চয়।” ফেরার পথে ডেইলি প্যাসেঞ্জার ভদ্রলোকের কথায় আমি ও আমার ভাবনা এক কঠিন, রূঢ় বাস্তবের জমিতে আছড়ে পড়ল। ছবিটা আমি মোবাইল থেকে জুম করলাম ও খেয়াল করলাম আমার অজান্তে এক নির্মম ছবি তুলেছি। বাফার দুটোর মাঝখানে যে চৌকো জায়গাটা করা সেটার ভিতরে অর্ধেক ও বাইরে অর্ধেক দড়ি দিয়ে মুখ বাঁধা কালো বস্তাটাতে কোনো মানুষের লাশ আছে। হ্যাঁ!! লাশ, সকালবেলা যে মানুষটা জলজ্যান্ত বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছিলো নিজের সত্তা বা নিজের শ্রম বিক্রি করে স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে সে নিয়তির অলিখিত নিয়মে একটা বস্তা বাঁধা লাশে পরিণত হল। তাই তার আর কামরায় জায়গা হলনা, লাগলো না গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য কোনো টিকিট।
অপেক্ষা করবে হয়ত তার ছেলে-মেয়ে বা বাবা-মা, চায়ের দোকানের আড্ডারত বন্ধুরা বা ড্রেসিং টেবিলের ঢাকনা না আটকানো লিপস্টিকটা। এই অপেক্ষা অনন্তকালের অপেক্ষায় পরিণত হয়ে গেলো, কারণ সে তো আর মানুষ নয়। রেলপুলিশের খাতায় সে এখন “লাশ”।
ছবি : রৈনাক দত্ত
Facebook Comments