গল্পের শুরুটা হয়ে ছিল একটা ফোন আমন্ত্রণে। সবে সবে মাতৃপক্ষের সূচনা হয়েছে। কিন্তু মনে শঙ্কা নিয়ে তখনও ভাবছি মায়ের মুখটা বুঝি বোকাবাক্সয় দেখতে হবে এবার। তারপর কত নিয়মকানুন মায়ের অঞ্জলীতে।
সকালে একটা ফোন এলো, তোমাকে তৃতীয়াতে বিলাসপুর আসতে হবে। কি যে বলি! পালটা জিগেস করার সাহস হলোনা। কিন্তু মনে লাড্ডু ফুটছে। ছবিতে বহুবার দেখেছি হোটেলটাকে। যেন এক রাজপ্রসাদ। বলা হয়নি ফোনটা করেছিলেন স্বয়ং বিলাসপুরের “দ্য আনান্দা ইম্পিরিয়াল হোটেলের” জি. এম. রাজীব রায় চৌধুরী। সত্যি আমার কাছে বেশ বড় পাওয়া এই আমন্ত্রণ। আমি একজন হোমসেফ। আমন্ত্রণটা বেড়াতে যাওয়ার আবার কিছুটা কাজেরও ছিল তবে পুজোর আমাজে। প্রবাসে পুজো দেখার এমন সুযোগ হাতছাড়া করিনি, ব্যাস রেডি হয়ে উঠে পড়লাম মুম্বাই মেলে গন্তব্য বিলাসপুর। আনান্দাতেই (The Aananda Imperial Hotel) পুজোর কটা দিন থাকব। ছেলেবেলা থেকে কোন দিন পরিবার ছাড়া পুজো কাটেনি আমার, মনটা কিছুটা ভারাক্রান্ত ছিল ট্রেনে ওঠার পর থেকে। আবার প্রবাসে পুজো দেখব বাঙালীয়ানায়, তাই নিয়েও উৎসাহের কমতি ছিলনা মনে মনে।
আজ ষষ্ঠী। ঘন্টা খানেক দেরী হল বটে, এবার ট্রেন থেকে নামার পালা। কোথায়? ভুলে গেলেন বলেছিলাম গন্তব্য বিলাসপুর। ট্রেন থেকে নামতে আথিতিওতা শুরু। হোটেলের গাড়ি দাঁড়িয়ে। চললাম হোটেলের দিকে। চারদিকে ব্রিটিশ স্থাপত্য। মিনিট দশেকে পৌঁছে গেলাম হোটেলের দোর গোরায়। বিশাল এক অট্টালিকা। শান্ত পরিবেশ। বাঁ দিকে চোখ পরতে দেখলাম পুজোর মণ্ডপ সাজানোর কাজ তখনও চলছে। গাড়ি থেকে নামতে ব্যাগ স্যানিটাইজ করা হলো নেওয়া হলো কোভিডের কারণে নেওয়া যে সমস্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা হয়েছে। আগে থেকেই আমার থাকার জন্য সুন্দর একটা রুম রেডি করা হয়েছে। পরিপাটি, ছিমছাম বিলাসিতার ছোয়া।
রুমে ঢুকে ফ্রেস হতেই ফোন এলো মায়ের আরতি দেখার, হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন, মা দুর্গা আরতি। আমার দেখা প্রথম নিয়ম মেনে বনেদিয়ানায় পুজো তাও আবার হোটেল। রুম থেকে বেরতেই কানে এলো ঢাকের বাজনা।
ঢাকের বাজনায় কেমন একটা শিহরণ জাগে মনে সাথে চোখ ছানাবড়া। কেন? করোনা কালে মায়ের বরণে ১৭ জন ঢ়াকি এসেছে আনান্দায়। সন্ধে বেলায় ফিতে কেটে মায়ের আগমনের সুচনা করলেন আনান্দার কর্ণধার শ্রী দুলারাম বিধানী। করা হলো মিষ্টি মুখ। পুজো শুরু। মাঠে সুন্দর দুরত্ব মেনে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। চলছে ষষ্ঠীর পুজো।
এরই মধ্যে হঠাৎ ডাক এলো দাদার অফিস রুম থেকে। দাদা মানে রাজীব রায় চৌধুরী। বেশ, কিছু দায়িত্ব দিলেন আমায়। তিন দিন বুফেতে আমার রান্না যাবে। আগে থেকে সেট করা মেনু দেখে আমায় সেট করতে হবে এর সাথে কোন খাবার বা রেসিপিটা যাবে। কাল সকালে জানাতে হবে। জানানো হলো ভোরে কলা বউ স্নানে যাবো কিনা… সত্যি বলতে এমন সুযোগ আগে আসেনি আমার। তাই বেশ অতি আগ্রহে তিনটে বাজতে ঘুমটা আচমকা ভেঙে গেল। ব্যাস রেডি হয়ে বসে রইলাম কখন ডাক আসে। কানে এলো ঢাকের বোল। রুম থেকে বেরিয়ে গুটি গুটি পায়ে মায়ের মন্ডবে। সেখানে চলছে কলা বউ স্নানের প্রস্তুতি। মিস করতে চাইনি। আগেই বলেছি কখনও দেখার সৌভাগ্য হয়নি, আমার দেখা প্রথম কলা বউ স্নান। এত সুন্দর কিছু মুহূর্ত হয়ত আমার জীবনে আসত না The Aananda Imperial আসার আমন্ত্রণ না পেতাম। বেশ ১০/১২ টি গাড়ি লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে। সবাই নির্দিধারিত গাড়িতে উঠে পড়লেন। চারদিকে সবুজ গাছের সারি বেয়ে গাড়ি এগিয়ে চলল নদীর ঘাটে। এবার মন্ত্র উচ্চরণে কলা বউ স্নান সারা হলো। মনে হচ্ছিল এটা কোন বনেদি বাড়ির পুজো। হোটেলের প্রতিটি কর্মচারী পুজোর কাজে নিজেকে ব্যস্ত করে নিয়েছে তবে তাদের কাজের কমতি রেখে নয়। এবার কলা বউ স্নান শেষে হোটেলে ফেরা।
আজ মহাসপ্তমী। রুমে ঢুকে অর্ডার করলাম সকালের জল খাবার। হ্যাঁ খাবারের কথায়, এখানের সব খাবারই ভালো। বাঙালীহাতে হাতের লুচি কিংবা স্যান্ডউইচ, চায়নিজ অথবা বিরিয়ানী, সবই আছে সারাদিনের মেনুতে। সাথে রাতে বুফে। আর সেই পুজোর বুফে মেনুতেই থাকবে আমার একটা রেসিপি।
আগেই বলেছি মেনু সেট করতে বলেছিলেন দাদা। বেশ উৎসাহ নিয়ে সেট করলাম তালিকা। বেশ কয়েকটা রেসিপি থেকে বাছাই করে নেওয়া হলো আজ একটা মাছের রেসিপি। নাম মেথি কাতলা। যথারীতি সেফের রুম থেকে ডাক এলো সমস্ত উপকরণ বলে এলাম । রান্না আমার নেশা পেশা ধ্যান সবকিছু। আমার স্বপ্নময় বহ্নি স্ কিচেনের সমস্ত রান্না আমি নিজেই সামলাই তবে আনান্দার মত হোটেল কিচেনে রান্নার অভিজ্ঞতা ছিল প্রথম। বেলা চারটে এবার আমার রান্নার পোশাকে চললাম হোটেল কিচেনে। বড় বড় হাতাখুন্তি কড়াই। নিয়ে বেশ দক্ষতা দেখিয়ে শেষ করলাম রান্না।
আবার অফিস থেকে ডাক এলো। এবারের আর্জি ব্রাহ্মণ ভোজনের অষ্টমীতে ও একাদশীতে। সাথে মেনু কি হবে তাও। সত্যি কিছু মুহুর্তের প্রাপ্তি বড় মধুর। আজ মহাষ্টমীতে আমার প্রাপ্তি তেমনি। এবারের পুজোতে আমি বাড়ি থেকে অনেক দূরে। কিন্তু বড় একটা সুযোগ হলো ভোজনের দায়িত্ব। মেনু সেট করে দাদাকে (রাজীব রায়চৌধুরী) দেখালাম। রাজি হয়ে গেলেন সবাই। সেই মেনুতে রেখেছিলাম সাদাভাত, পোস্ত আলুভাজা, বেগুনী, হিং দিয়ে ডালের বড়া, শুক্তো, ঝিঙে আলু পোস্ত, দুধ পনির আর আমের চাটনি।
রান্না করলাম যথারীতি। রান্না শেষ হতে। চলে গেলাম সেখানে যেখানে ব্রাহ্মণদের ভোজনের ব্যবস্থা হয়েছে, রুমে ঢুকতে কানে এলো, সবাই আমার রান্নার প্রশংসা করছেন। তার সঙ্গে আরও বড় প্রাপ্তি হল নাফিসা দি (রাজীব দার গিন্নী) তখনও তাকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি আমার। তিনি যখন ফোন করে আমার রান্নার প্রশংসা করলেন । এটা আমার সত্যি বড় প্রাপ্তি। সাথে সুমিত স্যার, রাজীব দাদা, আর ব্রাহ্মণরা।
এবার পালা অষ্টমীতে মেনুর রান্না নাকে মুখে কটা দিয়ে চললাম কিচেনে আজ মেনুতে যাবে চিকেনের রেসিপি নাম বাদামি চিকেন। রান্না শেষ বুফে সাজানো হলো। সেখানে আরেক প্রাপ্তি দাদা গেস্টদের সাথে আমার পরিচয় করালেনও। প্রাপ্তি ঝুলি একেক দিন এক এক করে ভরছে।
আজ মহানবমী। কুমারী পুজো আগের দিন মাঠে মণ্ডপের পাশে দুস্টু মিস্টি ছোট্ট মেয়ের সাথে পরিচয় আজ কুমারী পুজোতে সে নাকি মা উমা। সবাই বেশ উৎগ্রিব.. বসবে তো শান্ত হয়ে। কিনকরবে কে জানে? তাকে শান্ত ভাবে বসিয়ে রাখতে কত কি জল্পনাকল্পনা। পুজো শুরু। না সবাই কে তাক লাগিয়ে কুমারী মাতা তার পুজো গ্রহণ করলো। টিভিতে বহুবার দেখেছি আজ আবার প্রথম দেখলাম। প্রতি সন্ধ্যে বেলায় বেশ আরতি ঢাকের বাজনা বেশ জমে ক্ষীর। করোনার কারণে এবারের পুজোতে শিল্পী সমাগম হয়নি। কিন্তু পুজোর নিয়মাবলী তে কোন কমতি ছিল না। নবমীর রাত বিষাদময় হয়ে ওঠে কাল যে উমা ফিরবে কৈলাশে।
দেখতে দেখতে দশমী চলে এলো। হ্যাঁ মা ফিরবেন কৈলাশে… আবার প্রতিক্ষার পালা বছর জুড়ে। তবে এবছর মা আমার ঝুলিতে একটু বেশি আনন্দঘন মুহুর্ত ভরে দিয়েছেন।
সকালে মায়ের বরণ করে নেওয়া হলো সিঁদুর দানে। মিস্টি মুখ করলেন। আমার দেখা মত প্রথম হোটেল যেখানে মিস্টিটাও নিজেরা তৈরি করেন। বেলা পড়তেই মণ্ডপের পাশে সবাই আবির নিয়ে তৈরী মাকে হাসি মুখে বিদায় দিতে হবে। ঢাকিদের ঢাকের বাজনা তালে প্রতিমা তোলা হলো গাড়িতে।
এবার চলার পালা নদীর ঘাটে। মাঝ পথে হোটেলের সিওও সুমিত স্যারের বাড়িতে ভুরিভোজের আয়োজন। স্যারের বাড়ি থেকে ফিরে আসলাম আনান্দায়। আমার বির্সজন দেখা হল না। আমার আর বির্সজন দেখা হল না । বেশি লোকজন যাওয়া যে মানা, কোভিড প্রটোকল।
মা চলে গেলেন। আজ একাদশীর ব্রাহ্মণ ভোজনের দ্বায়ীত্ব আমার। … মেনুও সেট থেকে রান্না…মাঝে বাজার করা টাও ছিল। মনটা একটু খারাপ। চাক্ষুষ দেখতে পায়নি না, দূর্গা বিসর্জন… সেখানেও কমতি রাখেনি দ্য আনান্দা ইম্পিরিয়াল। দারুন কিছু ছবি শেয়ার করেছেন বিসর্জনের।
সত্যি ভাবতে পারিনি হোটেলে বনেদিয়ানায় পুজো হতে পারে সমস্ত নিয়ম নীতি মেনে। ঢাক, কাসোঁর মন্ত্র কোথাও ছিল না কমতি। আর অতিথিয়তা সে তো অতুলনীয়। আমার জীবনের প্রথম.. যে অভিজ্ঞতা আগে হয়নি… চারতারা হোটেলে রান্না, সেই রান্না বুফে মেনুতে যাওয়া, ব্রাহ্মণ ভোজনের দ্বায়ীত্ব, কুমারীপুজো, খাওয়া দাওয়া, পুজোর ভোগ। আমার মত শহরের কোলাহলে যাদের পুজোর স্মৃতি বিলীন তারা বিলাসপুরের আনান্দায় আসতে পারেন বনেদিয়ানায় পুজো উপভোগ করতে।
আবারো ধন্যবাদ
(The Aananda Imperial by Svenska) আনান্দাকে (Rajib Roy Choudhury) দাদাকে এবং (Sumit Vidhani) সুমিত স্যারকে আমায় আমন্ত্রণ জানানোর জন্য।
Facebook Comments