ট্রামযাত্রা বা কলকাতা ট্রাম ব্যবহারকারী সমিতি (CTUA) সুইচঅন ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় শনিবার কলকাতা ট্রামওয়ের ১৫১তম বার্ষিকী উদযাপন করেছে৷ এই সময়ের মধ্যে একটি বিশেষ ট্রাম যাত্রার আয়োজন করা হয়েছিল। অতীতের আসল স্ট্যাম্প, ফটোগ্রাফ সহ ভিতরে ভিনটেজ ট্রামের একটি বিশেষ প্রদর্শনী করা হয়েছিল।
গড়িয়াহাট ট্রাম ডিপোতে সকাল ১০টায় শুরু হয় অনুষ্ঠান। দুটি সাজানো ট্রাম গড়িয়াহাট ট্রাম ডিপো থেকে এসপ্ল্যানেড ট্রাম টার্মিনাসের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে। মহাদেব শী (চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং ট্রামযাত্রার সহ-প্রতিষ্ঠাতা) বলেছেন, ‘একটি জীবন্ত ঐতিহ্য, ট্রাম অতীতের একটি ধ্বংসাবশেষের চেয়ে বেশি। ‘এটা আতঙ্কজনক যে আমরা ট্রাম থেকে মুক্তি পাওয়ার কথা ভাবছি।’
এদিকে CTUA সভাপতি দেবাশীষ ভট্টাচার্য বলেন, ‘ট্রাম বাতিলের বিরুদ্ধে আমাদের উদ্যোগ একটি সাংস্কৃতিক প্রতিবাদ।’ বিনয় জাজু, এমডি, সুইচন ফাউন্ডেশন, বলেন, ‘আমরা এমন একটি ভবিষ্যৎ কল্পনা করি যেখানে গণপরিবহন সবার জন্য সহজলভ্য, সাশ্রয়ী, দক্ষ এবং সবুজ। ট্রাম শহর এলাকায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অভিনেতা/নাট্য পরিচালক রুদ্র প্রসাদ সেনগুপ্ত বলেছেন, অতীতকে কেউ আলাদা করতে পারবে না। কিছু পুরানো হওয়ার অর্থ এই নয় যে এটি বাতিল করা উচিত। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘ট্রাম শুধু কলকাতার পরিবহনের মাধ্যম নয়, ট্রাম সরানো আমাদের দূষণ কমানোর প্রচেষ্টার ওপর সরাসরি আক্রমণ।’
১৫১ বছর পূর্বে কলকাতার রাজপথে যার যাত্রা শুরু হয়েছিল গতিহীনতার দোহাই দিয়ে তার অন্তিম যাত্রার প্রস্তুতি আগতপ্রায়। অথচ দূষণমুক্ত সেই পরিবেশ বান্ধবকে আজ এই তিলোত্তমা শহরের বড় বেশি প্রয়োজন ছিল। কলকাতার ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিকভাবে জড়িত প্রাচীনতম ‘আধুনিক’ বাহন এই ট্রাম। ১৮৭৩ সালে ২৪শে ফেব্রুয়ারি কলকাতায় প্রথম ঘোড়ায় টানা ট্রাম ( শিয়ালদা থেকে আর্মেনিয়ান ঘাট পর্যন্ত ৩:৯কিলোমিটার রাস্তা) চলে। যদিও নয় মাস পর তার চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরে আবার ফিরে এলেও ৭ বছর পর হঠাৎই বন্ধ হয়ে যায় এই পরিষেবা। কারণ যথেষ্ট যাত্রীর অভাবে ব্যবসায়িক দিক থেকে অলাভজনক হয়ে উঠে এই পরিষেবা।
এরপর ১৮৮০ সালে লর্ড রিপনের উদ্যোগে আবার কলকাতার রাস্তায় ট্রামের চলা শুরু। প্রতিষ্ঠিত হয় একটি কোম্পানি। কোম্পানির এক হাজার ঘোড়া পোষ্য ছিলো শুধু ট্রামগুলি টানবার জন্য। ১৯ মাইল বিস্তৃত ট্রাম লাইন ধরে এ ঘোড়াগুলি ট্রাম টেনে নিয়ে যেত।
১৯০০ সালেরর দিকে প্রথম বৈদ্যুতিক ট্রাম চালানোর পরিকল্পনা শুরু হয়। কেননা ততদিনে ১৮৯৯ সাল থেকেই কলকাতায় বিদ্যুত যুগের সূচনা হয়ে গেছে।
১৯০২ সালের ২৭শে মার্চ কলকাতায় বৈদ্যুতিক ট্রামের গোড়াপত্তন। এসপ্লানেড থেকে খিদিরপুর পর্যন্ত। ঐ বছরই জুন মাসে আরেকটি রুটে এসপ্লানেড থেকে কালীঘাটে ট্রাম চালু হয়ে যায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য তার আগে বিশ্বে প্রথম ট্রাম চালু হয়ে যায় ১৮০৭ সালে লন্ডনে। ব্রিটেনে প্রথম বৈদ্যুতিক ট্রাম চালু হয় ব্লাকপুল ট্রামওয়েজে ১৮৮৫ সালে , যা আজও সম্ভবত চালু। ১৮৭৮ সালে ক্যালকাটা ট্রামওয়েজ কোম্পানির পত্তন। আর ১৮৮২ সালে কলকাতায় স্টিম স্রেটড ট্রামের গোড়াপত্তনের চেষ্টা যা চূড়ান্ত অসফল হয়। ১৯০০ সালে আবার বাষ্পীয় ট্রাম চালানোর প্রচেষ্টা এবং কিছুদিন পরেই পরিকল্পনার ইতি। এতো ব্রিটিশ জাত্যাভিমানে সরাসরি আঘাত। কেননা লন্ডনের পর কলকাতা তখন ব্রিটিশদের দ্বিতীয় রাজধানী। অবশেষে কিলবার্ন কোম্পানির সহযোগিতায় ১৯০২ সালে ২৭শে মার্চ কলকাতায় বৈদ্যুতিক ট্রামের গোড়াপত্তন।
১৯০২ সালে ধর্মতলা থেকে খিদিরপুর পর্যন্ত প্রথম বিদ্যুৎচালিত ট্রাম চালানো শুরু হয়। এরপর উত্তর থেকে দক্ষিণ গোটা কলকাতাজুড়ে শুরু হয় বিদ্যুৎচালিত ট্রামের যাত্রা। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই কলকাতার মানুষের পছন্দের বাহনে পরিণত হয় ট্রাম। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো ১৯২০ সাল পর্যন্ত কলকাতার একমাত্র গণপরিবহন ছিলো ট্রাম। ১৯২০ সালের পরে কলকাতায় বাস পরিষেবা চালু হয়। ১৯৭২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কলকাতা ট্রামওয়েজ কোম্পানির ব্যবস্থাপনা অধিগ্রহণ করে। সেই সময়ের মধ্যেই কলকাতার বিভিন্ন পথে ট্রাম চালনা ও সেগুলিকে রাখার জন্য তৈরি হয় ‘ট্রাম ডিপো’। সেই সময় কলকাতায় ১২৫টি ট্রাম প্রতিদিন চলাফেরা করতো। দুই কামরার ট্রামগুলির গড় দৈর্ঘ্য ৬৪ ফুট, ওজন গড়ে ২০ থেকে ২২ টন। কলকাতার ট্রামগুলিকে বেশিরভাগ তৈরি করেছে কলকাতার বিখ্যাত বার্ন স্ট্যান্ডার্ড কোম্পানি। প্রতিটি ট্রাম চালাতে ৫৫০ ভোল্ট বিদ্যুতের দরকার হতো। আগে ট্রামে দুটি শ্রেণী (প্রথম ও দ্বিতীয়) থাকলেও পরে তার অবলুপ্ত হয়।
এর আগেই ১৯৫৫ সালে গোটা বিশ্বজুড়ে ট্রাম বাতিলের হিড়িক পড়ে। তার আগে ভারতে ১৯৩৩ সালে কানপুর থেকে ট্রাম তুলে দেওয়া হয়। ১৯৫৫ সালে চেন্নাই, ১৯৬২ সালে দিল্লি, ১৯৬৪ সালে মুম্বাই শহর থেকে তুলে দেওয়া হয় ট্রাম। তবে কলকাতা সবসময়ই ট্রামের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। আগে শহরের ২৫টি রুটে ট্রাম চলাচল করলেও বর্তমানে মাত্র দুটি রুটে ট্রাম চালু আছে। ধর্মতলা-গড়িয়াহাট এবং বালিগঞ্জ-টালিগঞ্জ রুটে। এখন আরো দুটি রুটে ধর্মতলা-খিদিরপুর (হেরিটেজ রুট) এবং ধর্মতলা- শ্যামবাজার রুটে ট্রাম চালানোর কথা চিন্তা ভাবনা চলছে।
ট্রামের দেড়শো বছরের ইতিহাসে দুটি উল্খেযোগ্য ঘটনার কথা না বললেই নয়।
এক) ১৯৪৩ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারি কুয়াশাময় ভোরে কলকাতার দিক থেকে আসা একটি ট্রাম সকলের অগোচরে মুষ্টিমেয় যাত্রী নিয়ে হাওড়া ব্রিজ পার হয়ে হাওড়া স্টেশনের কাছে যাত্রা শেষ করল। এইভাবেই হাওড়া ব্রিজের উদ্বোধন হয়। সেটা ট্রামের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল দিন ছিল।
দুই) কিন্তু ১৪ই অক্টোবর ১৯৫৪ সাল, ট্রামের ইতিহাসে একটি কালো দিন। কলকাতায়ম ট্রাম দুর্ঘটনায় আহত হন কবি জীবনানন্দ দাশ। ট্রামের ক্যাচারে পিষে যায় তার শরীর। ভেঙে যায় কণ্ঠা, ঊরু ও পাঁজরের হাড়। গুরুতরভাবে আহত কবি জীবনানন্দের চিৎকার শুনে ছুটে আসেন সামনের একটি চায়ের দোকানের মালিক চূণীলাল এবং অন্যরা। ট্রামের তলা থেকে তাকে উদ্ধার করে ভর্তি করা হয় শম্ভূনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে। ২২ অক্টোবর তার মৃত্যু হয়।
কলকাতা ট্রাম নিয়ে মাঝে মাঝেই চেষ্টা করা হয়েছে কিছু ভালো কাজ করার। ভ্রাম্যমান ক্যাফে বা লাইব্রেরি তার উল্লেখয্যোগ্য প্রমাণ। এছাড়া করা হয়েছে একটি ট্রাম মিউজিয়াম। যার নাম রাখা হয়েছে “স্মরণিকা”।
ট্রাম নিয়ে এই শহরের মানুষের একটা আবেগ আর নস্টালজিয়া অবশ্যই আছে। যদি এই শহর থেকে ট্রাম বিদায় নেয় তাহলে ইতিহাস আর ঐতিহ্যকে বুকে নিয়ে কলকাতার মানুষরদের গতিময় ব্যস্ত জীবনের মাঝেও তার অভাব অনুভূত হবে। যদিও একেবারে বিদায় ঘন্টা না বাজিয়ে অপেক্ষাকৃত কম ভীড় এলাকায় ট্রামকে চালু রাখার একটা চেষ্টা শুরু হয়েছে।
তথ্যঃ সংগৃহিত
Facebook Comments