নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ফলাফল আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ। আর সেই রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী বীর শহীদদের স্মরণে জাতির শ্রদ্ধা নিবেদনের চিরন্তন প্রতীক হচ্ছে জাতীয় স্মৃতিসৌধ। এটিই মুক্তিযুদ্ধের প্রথম স্মৃতিসৌধ। এই স্মৃতিসৌধ বাঙালির অস্তিত্ব আর জাতীয়তাবোধের প্রতীক। বাঙালির ইতিহাসের স্মারক।
১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের দিনে ঘুরে আসতে পারেন এই স্মৃতিময় স্থান থেকে। বিস্তারিত জানাচ্ছেন রবিউল কমল।
পরিচিতি
জাতীয় স্মৃতিসৌধ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নিবেদিত একটি স্মারক স্থাপনা। এখানে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের ১০টি গণকবর। স্মৃতিসৌধটির উচ্চতা ১৫০ ফুট। সৌধটি সাত জোড়া ত্রিভুজাকৃতির দেয়াল নিয়ে গঠিত। দেয়ালগুলো ছোট থেকে ক্রমশ বড় ক্রমে সাজানো হয়েছে। এই সাত জোড়া দেয়াল বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাতটি ধারাবাহিক পর্যায়কে নির্দেশ করে। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৫৬-এর শাসনতন্ত্র আন্দোলন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ- এই সাতটি ঘটনাকে স্বাধীনতা আন্দোলনের পরিক্রমা হিসেবে বিবেচনা করে সৌধটি নির্মিত হয়েছে। বিদেশি রাষ্ট্রনায়করা সরকারিভাবে বাংলাদেশ সফরে এলে এই স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন রাষ্ট্রাচারের অন্তর্ভুক্ত।
ইতিহাস
১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের পরপরই ১৯৭২ সালে মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের স্মরণে জাতীয় পর্যায়ে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। তার ফলাফল স্বরূপ ১৯৭২ সালে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতিসৌধের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ১৯৭৮ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান স্মৃতিসৌধটি নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং নকশা আহ্বান করেন। ১৯৭৮ সালের জুন মাসে প্রাপ্ত ৫৭টি নকশার মধ্যে সৈয়দ মাইনুল হোসেন প্রণীত নকশাটি গৃহীত হয়। ১৯৭৯ সালে মূল স্মৃতিসৌধের নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং ১৯৮২ সালে বিজয় দিবসের অল্প পূর্বে সমাপ্ত হয়। জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণের কাজ তিনটি পর্যায়ে সম্পন্ন করা হয়।
স্মৃতিসৌধে যা আছে
স্মৃতিস্তম্ভ এবং এর প্রাঙ্গণের সর্বমোট আয়তন ৩৪ হেক্টর (৮৪ একর)। এ ছাড়াও রয়েছে একে পরিবেষ্টনকারী আরও ১০ হেক্টর (২৪ একর) এলাকা নিয়ে বৃক্ষরাজি পরিপূর্ণ একটি সবুজ বলয়। স্মৃতিসৌধ মিনারটি ৪৫ মিটার উঁচু এবং স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিন্দুতে অবস্থিত। মিনার ঘিরে আছে কৃত্রিম হ্রদ এবং বাগান। স্মৃতিসৌধের মূল কাঠামোর সামনেই রয়েছে একটি জলাশয়। এখানে প্রতিফলিত হয় জাতীয় স্মৃতিসৌধের মূল কাঠামো এবং জাতীয় পতাকা। এই জলাশয়ে ফুটে আছে অসংখ্য শাপলা ফুল।
স্মৃতিসৌধে প্রবেশের পর প্রথমেই চোখে পড়ে শ্বেতপাথরে উৎকীর্ণ একটি লেখা। ‘বীরের এ রক্তস্রোত মাতার এ অশ্রুধারা/এর যত মূল্য সে কি ধরার ধূলোয় হবে হারা’-এর একটু সামনেই শ্বেতপাথরের ভিত্তিপ্রস্তর। এর পরই ডানদিকে রয়েছে নজরকাড়া উন্মুক্ত মঞ্চ। সোজা হেঁটে গেলে মূল স্মৃতিসৌধ। তবে স্মৃতিসৌধ কমপ্লেক্সের প্রধান ফটক দিয়ে কেউ যখন এ এলাকায় প্রবেশ করেন তখন তিনি প্রথমেই স্মৃতিসৌধটি দেখতে পান। যদিও সৌধ পর্যন্ত যেতে হলে তাকে অনেক দীর্ঘ পথ হাঁটতে হয়। এই পথের মধ্যে রয়েছে অনেকগুলো উঁচু-নিচু চত্ত্বর। এই চত্ত্বরগুলো পার হতে হলে তাকে কয়েক ধাপ সিঁড়ি দিয়ে বেশ কয়েক বার ওঠানামা করতে হয়। তারপর পার হতে হয় বড় একটি কৃত্রিম জলাশয়। জলাশয় পার হওয়ার জন্য রয়েছে সেতু। এই পথের দু’পাশে রয়েছে গণকবর। প্রতিটি চত্বর ও সিঁড়ি লাল ইটের তৈরি।
এছাড়া সীমানা প্রাচীরের ভেতর রয়েছে প্রশস্ত ইটের পাকা রাস্তা, রাস্তার দু’পাশে নানা জাতের ফুলের গাছ, কৃত্রিম জলাশয়, উন্মুক্ত মঞ্চ, আলাদা করে ফুলের বাগান, অভ্যর্থনা কেন্দ্র, হেলিপ্যাড, ক্যাফেটেরিয়া, মসজিদ, রেস্তোরাঁ, রক্ষণাবেক্ষণের কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য আবাসিক এলাকা ইত্যাদি। দূর-দূরান্ত থেকে আসা গাড়ির পার্কিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া ফলদ, বনজ ও ঔষধি গাছের সমন্বয়ে রয়েছে আলাদা বাগান।
যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশে সাভারের নবীনগরে অবস্থিত জাতীয় স্মৃতিসৌধ। ঢাকা থেকে আরিচাগামী যেকোনো পরিবহন বা ব্যক্তিগত গাড়িতে যেতে পারবেন জাতীয় স্মৃতিসৌধে।
পরিদর্শনের সময়সূচি
জাতীয় স্মৃতিসৌধ প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত থাকে। স্মৃতিসৌধে যেতে কোনো প্রবেশ মূল্য লাগে না। বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবসসহ বিশেষ জাতীয় দিবস ও সাপ্তাহিক ছুটির দিনে এখানে জনতার ঢল নামে।
ছবি : বিউটিফুল বাংলাদেশ
Facebook Comments