বুকের এক্স রে দেখিয়েছিল রোগীর হার্ট বুকের এক দিকে চলে এসেছে, অস্ত্রোপচার ছাড়া চিকিৎসা নতুন জীবন দিল রোগীকে বিহারের প্রত্যন্ত বাহাদুরপুর গ্রামের ২৩ বছর বয়সী কুমারের চার বছর বয়েস থেকেই হার্টের সমস্যা। খুব অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে পড়ত সে এবং সাথে সাথে ঠোঁট ও আঙুলগুলো নীল হয়ে যেত। স্থানীয় ডাক্তাররা জানিয়েছিলেন যে অস্ত্রোপচার দরকার এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে। কিন্তু আর্থিক অনটনের জন্য সেই সময়ে অস্ত্রোপচার করানো হয়নি কুমারের। পরিস্থিতি খারাপের দিকেই যেতে থাকে। কুমারের যখন ১৭ বছর বয়স, তখন আরো অবনতি হয়। অল্প দূরত্ব হাঁটা শুধু নয়, সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই খুব কষ্ট হতো। এই অবস্থায় বিহারের একটি সরকারি হাসপাতালে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় এবং কলকাতার এক হৃদরোগ বিশেষজ্ঞর কাছে রেফার করা হয় থাকে।
বর্তমানে কলকাতার একটি প্রথম সারির বেসরকারি হাসপাতালে অস্ত্রোপচার ছাড়াই সুচিকিৎসায় জন্মগত হার্টের সমস্যা কাটিয়ে উঠে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে সে। নিজের বাইশ বছরের জীবনে যে এই প্রথম কোন বিভ্রাট ছাড়া চলাফেরা করছে কুমার। যেই ছেলের আগে ১০০ মিটার দৌড়াতে গেলে প্রাণ কাহিল হয়ে যেত, এখন সেই পরিস্থিতি একদম উল্টো।
ফিরে আসা যাক কলকাতার হাসপাতালে চিকিৎসার দিনগুলোর কথায়। ডঃ রানা রাঠোর রায়, মেডিকা সুপার স্পেশালটি হাসপাতালের ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজি বিভাগের অভিজ্ঞ পরামর্শদাতা কুমারকে দেখে জানান যে সে বিরল হার্টের অসুখে আক্রান্ত। আরো পরীক্ষা নিরীক্ষা ও দরকারী চিকিৎসার জন্য উনি ডঃ অনিল কুমার সিংঘী, মেডিকা সুপার স্পেশালটি হাসপাতালের ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজি বিভাগের অভিজ্ঞ পরামর্শদাতার কাছে রেফার করেন।
“তখন কুমারের ওজন ৩৫ কেজিরও কম ছিল। রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ ছিল মাত্র ৫৮ শতাংশ যা সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের ক্ষেত্রে ৯৮-১০০ শতাংশ থাকে। ছেলেটির উচ্চতা ছিল ৪ ফুট ৯ ইঞ্চি যা স্বাভাবিক ২৩ বছর বয়সী ছেলের চেয়ে খুব কম। বলাই বাহুল্য হার্টের অসুখের জন্য এই পরিস্থিতি হয়েছিল, ” জানান ডঃ অনিল কুমার সিংঘী।
কুমারের বুকের এক্স রে করে জানা যায় যে হার্ট বুকের ডান দিকে সরে গেছে। ইকোকার্ডিওগ্রাম করে বোঝা যায় যে হার্টের চেম্বার বাদিকে সরে গিয়েছে তবে কোন গর্ত নেই দুটি চেম্বারের মাঝে বা নিলয়ে, যা বাইরে থেকে দেখে মনে হচ্ছিল। বাদিকের ফুসফুসের দুই ধমনী যেখানে যুক্ত সেখানে একটি অস্বাভাবিকতা রয়েছে যা বাবল কনট্রাস্ট টেস্টে ধরা পড়ে।পরবর্তীকালে কমপিউটেড টমোগ্রাফিক এনজিওগ্রাম (সিটি পালমোনারি এনজিওগ্রাম) করা হয়েছিল এই সমস্যা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য এবং নিশ্চিত হওয়া যায় যে জন্মগত বাদিকের ধমনী আর আর্টারি মধ্যে যোগ রয়েছে। সব থেকে সরু জায়গাটা অস্বাভাবিকভাবে বেশ বড়, ব্যাস প্রায় এক ইঞ্চির মত, শরীরের সব চেয়ে বড় ধমনীর চেয়ে বড় আকৃতিতে। দূষিত রক্ত বিশুদ্ধ রক্তের সাথে মিশে নীল আভা (সাইনোসিস) হয় আঙুল, নখ ও ঠোঁটে।
সত্যি কথা বলতে কি এর চিকিৎসা মুশকিলের ছিল। আলোচনা হয়েছিল যে কোন ভাবে অস্ত্রোপচার ছাড়া পায়ের শিরাতে কোন যন্ত্র বসিয়ে সমস্যা কমানো যায় কিনা। এই ধরণের যন্ত্রগুলো হয় বেশ নরম, সহজে ভাঙে না এবং ক্ষয় হবে না। এক্ষেত্রে খুব বড় আকৃতির প্রয়োজন ছিল, জানান ডঃ সিংঘী।
এই অস্ত্রোপচারহীন ট্রান্স-ক্যাথিটার পদ্ধতি সম্পন্ন করতে লেগেছিল সব মিলিয়ে এক ঘন্টা পনেরো মিনিট। পায়ের শিরা দিয়ে যেই সমস্যা ছিল তা তার এবং ছোট ক্যাথিটার দিয়ে জড়িয়ে নেওয়া হয়েছিল। একটি বিশেষ শিথ ওই সমস্যার জায়গায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল কার্ডিয়াক ক্যাথিটারইজেশন ল্যাবরেটরিতে। একটি বড় ২৪ মিমি লাইফটেক মাস্কুলার ভিএসডি যন্ত্র বসানো হয় পর্যবেক্ষণের জন্যে এবং এনজিওগ্রামের জন্য। সঙ্গে সঙ্গে দেখা যায় যে রক্তে সেই নির্দিষ্ট পরিমাণ বেড়ে হয় ৯৯ শতাংশ, যা স্বাভাবিক।
“পুরো পদ্ধতি সাফল্যের সাথে শেষ হলে রোগীকে আইসিউতে নিয়ে যাওয়া হয়। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে কুমারকে সাধারণ ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তিন দিনের মধ্যে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। কুমারকে রক্ত সরু হওয়ার কিছু ওষুধ দেওয়া হয়েছে,” জানান ডঃ সিংঘী।
“এখন আমার নিশ্বাস নিতে কোন সমস্যা হয় না। এমনকি আমি পার্কেও যেতে পারি। আগে আমি কিছুটা বাড়িতেই আবদ্ধ থাকতাম। এখন আমি যে শুধু চারিদিক যেতে পারি তা নয়, ইতিমধ্যেই আমাদের গ্রামে যে সাতটা বিয়ে হল, সেখানে বার়াতের সাথে রীতিমতো নাচতে নাচতে গিয়েছি। পরের পাঁচ বছরের মধ্যে আমি বিয়ে করতে চাই এবং নিজের বিয়ের দিনও অনেক নাচতে চাই,” আত্মবিশ্বাসের সাথে জানায় মুকেশ কুমার। বর্তমানে স্থানীয় কনট্রাক্টরের সাথে রাস্তায় পাইপ বসানোর কাজ করে সে।
“এখন আমি ক্রিকেট খেলতে পারি তবে কমবয়সীদের সাথে খেলি কারণ বড়রা অনেক দ্রুত খেলে,” অকপটে জানায় মুকেশ।
” আমরা মেডিকার কাছে চির জীবন কৃতজ্ঞ থাকব এত কম খরচে এরকম চিকিৎসার জন্য। সুস্থ হয়ে যে এত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবে হাসপাতাল থেকে ভাবতেই পারিনি। শেষবার যখন চেক আপ হয়েছিল, তখন ওর ওজন ছিল ৪২ কেজির চেয়ে একটু বেশি,” জানায় মুকেশ, কুমারের বড় দাদা। শেষ দুই দশক ধরে মুকেশ নিজে সাইকেলের পিছনে বসিয়ে ভাইকে সব জায়গায় নিয়ে যেত। দৃশ্যতই অনেক স্বস্তিতে থাকা মুকেশ বলে,”এখন ভাই সম্পূর্ণ সুস্থ, কোন সমস্যা নেই।”
” মেডিকা সুপার স্পেশালটি হাসপাতাল সব সময়েই সুচিকিৎসার উপর জোর দেয় এবং রোগীর পরিবারের আর্থিক সক্ষমতা না থাকলেও চিকিৎসা আটকে থাকে না। বলাই বাহুল্য, কনজেনাইটাল হার্টের অসুখের চিকিৎসার ক্ষেত্রে এই উদাহরণ নতুন মাইলফলক। আশা রাখব যে সামনের দিনগুলোতেও মেডিকা নতুন ইতিহাস গড়বে। আমাদের পুরো মেডিক্যাল টিম এবং সহকর্মীদের এই অসামান্য সাফল্যের জন্য অনেক শুভেচ্ছা রইল”, বলেন ডঃ অলোক রায়, চেয়ারম্যান, মেডিকা সুপার স্পেশালটি হাসপাতাল।
Facebook Comments